মঙ্গলবার, ২১ মার্চ ২০২৩, ১০:৫৭ পূর্বাহ্ন

আত্মার প্রবৃত্তি বনাম ঈমানদীপ্ত আত্মা

রিপোর্টারের নাম
  • প্রকাশিতঃ সোমবার, ৬ জুলাই, ২০২০
  • ৪১ জন নিউজটি পড়েছেন

একজন মুমিন তার ঈমানী পথযাত্রায় নিজ ‘নাফসে’র দুনিয়াজাত আকাক্সক্ষার প্রণোদনা জানার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সচেতন থাকেন। কারণ ‘নাফসে’র প্রলোভনে বন্দী হয়ে পড়ার মধ্যে তার ঈমানী চেতনার সঙ্কোচন অথবা মৃত্যু হতে পারেÑ এ ধারণা তার ঈমানদীপ্ততায় বদ্ধমূল থাকা আবশ্যক। অন্যথায় বারবার অসাবধানতাবশত আত্মার প্রবৃত্তির কাছে পরাজয় স্বীকার করতে হবে। ঈমানদারের এ ধারণা আল্লামা ইবনে তাইমিয়ার ভাষায় যথার্থভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি বলেন, ‘নাফস’ হচ্ছে স্তূপকৃত ময়লা-আবর্জনার ক্ষেত্রবিশেষ। এখানে যত বেশি খোঁড়াখুঁড়ি করা হয় তত বেশি ময়লা-আবর্জনা বের হতে থাকে। সুতরাং এ স্তূপের ওপর শক্ত কোনো কিছু রেখে এটি পার হতে পারার মধ্যে নিষ্কৃৃতি আছে। তবে কেউ যদি অন্যথা করে ময়লার মধ্যে খোঁজাখুঁজি করতে থাকে, সে না পারবে এর তলানি স্পর্শ করতে, না পারবে এর ময়লার উদ্ভাস বন্ধ করতে।’ (দ্র. ইবনুল ক্বাইয়েম, মাদারিজুস-সালিকীন-২/৩১৩)
এখানে ইবনে তাইমিয়াহ মুমিনের ‘নাফসে’র নেতিবাচক চারিত্রিকতার কথা বলে মুমিনকে সাবধান করার প্রয়াস পেয়েছেন। তবে ইবনুল ক্বাইয়েম ‘নাফসে’র এ নেতিবাচক বাস্তবতাকে ইতিবাচকতায় রূপান্তরিত করার কথা বলেছেন। তার মতে, মৌলিকত্ব বিবেচনায় ‘নাফস’ এক ও অভিন্ন। তবে এর তিনটি গুণবাচক স্তর বা রূপ রয়েছে যথা : ‘নাফস আম্মারা বিস-সূ’(দুষ্কর্ম তাড়িত নাফস), [দ্র. ইউসুফ-৫৩] ‘নাফস লাউওয়্যামা’ (অন্যয় নিরোধক নাফস) [দ্র. আল-ক্বিয়ামা-২] এবং ‘নাফস’ মুত্বমাইন্নাহ (ন্যায়ে প্রশান্ত নাফস)। [দ্র. আল-ফাজর-২৭]
এরই আলোকে বলা যায় যে, একজন মুমিনের একান্ত করণীয় হলো তার ‘নাফসে’ সূ-এর দুষ্কর্ম প্রবণতার পার্থিব আশা-আকক্সক্ষার বৃত্তাবর্তন থেকে বের করে এনে অন্যায় নিরোধক ‘নাফসে’ লাউওয়্যামা-এর পরিচর্যা করে নিজের ‘নাফস’কে স্রষ্টানুবর্তী ও ন্যায়ে-প্রশান্ত আত্মিকতা অর্জন করা।
একজন মুমিন স্রষ্টাপ্রেমের শক্তিতে জয় করেন তার ‘নাফসে’র শয়তানি প্রলুব্ধতায় সাজানো দুনিয়ার পথ-প্রান্তর। মানব ‘নাফসে’র শয়তানি প্রবণতার আত্মপ্রকাশ ঘটে মূলত অহঙ্কার, হিংসা, রাগ আর কুপ্রভৃত্তির অদম্য তাড়নার রূপ ধারণ করে। এ চারিমাত্রিক অপগুণের অপছায়া সর্বক্ষণ ঈমানী জিন্দেগির পরিচ্ছন্নতাকে ঘোলাটে করে তোলে। এ ক্ষেত্রে একজন মুমিন আল্লাহর সর্বময় ক্ষমতা ও রহমতের সর্বজয়িতা অবলম্বন করে পুনরুদ্ধার করেন তার ঈমানী দিগন্তের কান্তিময়-স্বচ্ছতা। তিনি যখন আল্লাহর নিরানব্বই নামের পৃথক পৃথক কার্যক্রম ও পরিধি অবগত হন এবং এর মাধ্যমে আল্লাহর কাছে আশ্রয় নেন, তখন তিনি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সঙ্কট উত্তরণের পথে নিজেকে পুনর্বার পরিচালিত করতে সক্ষম হন।
একজন মুমিন জানেন যে, আকাশে বিচরণ করে বিশেষ মর্যাদা ও প্রাজ্ঞতা লাভকারী ফেরেশতার শয়তানি চরিত্রে রূপান্তর ঘটেছে মাটির আদমকে হিংসা করা ও অহঙ্কারবশত তাকে সেজদা না করার কারণে। তাই তো তিনি হিংসা আর অহঙ্কারের শয়তানি বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে আপন রবের রহমত থেকে বঞ্চিত হতে চান না। কারণ বড়ত্ব ও অহঙ্কারের মালিক যে তার রবÑ এ কথায় তিনি নতজানু। এ প্রসঙ্গে তার রবের ঘোষণা, অহঙ্কার আমার উপরের পোশাক আর বড়ত্ব বা উচ্চতা আমার নিচের পোশাক। এ দুটি পোশাকের যেকোনো একটি নিয়ে যে আমার সাথে টানাটানি করবে আমি তাকে জাহান্নামে ছুড়ে ফেলব। (সহিহ মুসলিম)
তিনি এও জানেন যে রাগ একটি আগুনজাত শয়তানি উপাদান যার বিক্ষুব্ধতায় সক্রিয় হয়ে ওঠে সব কুকর্মের বীজ। এ প্রসঙ্গে রাসূল সা: বলেন, রাগ শয়তান হতে উৎসারিত (একটি বোধ-প্রবণতা)। আর যেহেতু শয়তান আগুনের সৃষ্টি, আর পানি আগুনকে নিভিয়ে দেয়, সুতরাং তোমাদের কেউ রেগে গেলে সে যেন অজু করে। (মুসনাদে আহমাদ) অপর এক হাদিসে নবী সা: মুমিনকে বলেছেন, তোমাদের ঈমান তখনই পূর্ণতা অর্জন করবে যখন তোমাদের মনোবৃত্তি-মনোবাসনা আমি যা নিয়ে এনেছি তার অনুগত হবে। (আল-আরবা’উন আননাবাবী-৪১)
এভাবে তিনি ইসলামের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী অহংবোধ-হিংসা-রাগ আর কাম-প্রবৃত্তির অসংযত, ক্ষণস্থায়ী ও ঈমান বিধ্বংসী প্ররোচনার নিয়ন্ত্রণ ও অবদমন করে তার হেদায়াতের পথ উন্মুুক্ত ও বক্রতামুক্ত রাখার মরণপণ লড়াই চালিয়ে যান।
এখানে আশার কথা হলো একজন স্রষ্টাপ্রেমী মুমিন তার ‘নাফসে’র তাত্ত্বিক পরিচয় ও এ বিষয়ক জ্ঞান-প্রাজ্ঞতা অর্জন ছাড়াই আল্লাহর নৈকট্য, আনুকূল্য ও ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পারেন। আত্মোন্নয়নের এ প্রচেষ্টা-যুদ্ধে ইসলামের প্রথম প্রজন্মের (সাহাবায়ে কেরামের) জীবনরীতি ও কর্মধারা একজন মুমিনকে অনুপ্রাণিত করে। তিনি তাদের ‘সামিনা ওয়া আত্বানা’ তথা শুনা এবং (স্বপ্রণোদিতভাবে) মানা বা ‘আমল’ করার রীতির ভিত্তিতে তার ঈমানী পথ চলার কৌশল রপ্ত করেন। তিনি কোনো রকম যুক্তি-তর্কে না গিয়ে কুরআন-হাদিসের বাণীগুলোর চর্চা ও অনুশীলনের এক জীবনজাত ও বাস্তব রূপদানে আত্মনিয়োগ করেন। কুরআন-হাদিসের প্রতি এরূপ নিঃশর্ত মান্যতা-দানকারীদের মুমিন আখ্যা দিয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন : যখন তাদের মধ্যে (বিরোধ-নিষ্পত্তির) ফায়সালার জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের হুকুম মানার দিকে আহ্বান জানানো হয়, যারা ঈমান এনেছে তারা তখন শুধু এ কথাই বলে, আমরা শুনলাম এবং (যথারীতি) মানলাম। প্রকৃতপক্ষে ওরাই সফলকাম। (আন-নূর-৫১)
তাই একজন মুমিন এ আয়াতের মর্মকথায় প্রদীপ্ত হয়ে সব ধরনের সংশয়াচ্ছন্নতা পরিহার করে ঈমানের সরল পথে চলতে থাকেন নজিরবিহীন ভ্রƒক্ষেপহীনতায়। কেননা আল্লাহ তাকে বলেছেন : তিনি (আল্লাহ) এই কিতাব নাজিল করেছেন। এই কিতাবের আয়াতসমূহের মধ্যে কিছু মুহকাম আয়াত রয়েছে। আর অন্য কিছু আয়াত মুতাশাবেহ আছে। সুতরাং যাদের হৃদয়ে বিচ্ছুতিপ্রিয়তা আছে, তারা ফিতনা সৃষ্টি ও অপব্যাখ্যার প্রয়াসে মুতাশাবেহ আয়াতগুলোর অনুসরণ করে। অথচ কেবল আল্লাহই এসব আয়াতের প্রকৃত অর্থ অবগত আছেন। আর (এ ক্ষেত্রে) যাদের (ঈমান-প্রসূত) জ্ঞানের দৃঢ়তা আছে, তারা বলে : আমরা বিশ্বাস করি যে এ কিতাবের মধ্যে যা আছে, তা আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে যারা প্রজ্ঞাপূর্ণ বৌদ্ধিকতার অধিকারী তারাই সত্যাশ্রয়ী হয়ে থাকে। (আল-ইমরান : ৭)
তাই এ কথা অকপটে বলা যায় যে, কুরআন ও হাদিসের নিঃশর্ত ও আপাত যুক্তি-নিরপেক্ষ মান্যতার হৃদগত প্রেরণা সৃষ্টি ও এর ‘আমলগত’ রূপায়ণের ক্রমাগত প্রচেষ্টার অন্তরালে একজন মুমিনের কাক্সিক্ষত সাফল্য লুকিয়ে থাকে এবং এ মূল মন্ত্রই তার ঈমানদীপ্ততার প্রাণ ও প্রেরণার ভিত্তিভূমি।

নিউজটি আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন

এই ক্যাটাগরির আর নিউজ
© All rights reserved © vira-l.com 2017-2022
themesba-lates1749691102
Bengali English