মঙ্গলবার, ২১ মার্চ ২০২৩, ১০:২২ পূর্বাহ্ন

আর্থিক প্রতিষ্ঠানের টিকে থাকাই দায়

রিপোর্টারের নাম
  • প্রকাশিতঃ বৃহস্পতিবার, ৯ জুলাই, ২০২০
  • ৫২ জন নিউজটি পড়েছেন

এমনিতেই কয়েক বছর ধরে ব্যাংকের চেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাত। এর মধ্যে করোনাভাইরাস এসে এ খাতকে আরও বেশি সংকটে ফেলেছে। অনেক প্রতিষ্ঠানের এখন কোনো রকমে টিকে থাকাই দায়। বেশ কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আমানত কমছে। অনেক প্রতিষ্ঠান আমানতকারীদের সুরক্ষায় বাংলাদেশ ব্যাংকে বাধ্যতামূলক নগদ জমা বা সিআরআর রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। এর পাশাপাশি বাড়ছে খেলাপি ঋণ। কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে নানা অনিয়ম এবং পিপলস লিজিংয়ের অবসায়নের সিদ্ধান্তসহ নানা কারণে এ খাতে যে আস্থার সংকট সৃষ্টি হয়েছিল, তা থেকে বের হওয়ার নানা চেষ্টা চলছিল। সেই সময় করোনা সংক্রমণ সবকিছু ওলটপালট করে দিয়েছে।

আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতের সংশ্নিষ্টরা জানান, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ এমনিতেই বাড়ছিল। করোনার কারণে ঋণ আদায় ব্যাপক কমে গেছে। এতে করে টাকার প্রবাহ ব্যাপক কমেছে। এর মধ্যে আবার সাধারণ গ্রাহকের পাশাপাশি ব্যাংকগুলোর মধ্যেও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা তুলে নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। সব মিলিয়ে চরম সংকটে আছে তারা। তারল্য সংকট কাটাতে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর এমডিদের সংগঠন বিএলএফসিএর পক্ষ থেকে ১০ হাজার কোটি টাকার একটি বিশেষ তহবিল চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদন করা হয়েছে। তবে বিদ্যমান আইনে এ ধরনের তহবিল দেওয়ার সুযোগ নেই বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যদিও প্রতিষ্ঠানগুলোকে টিকিয়ে রাখতে সিআরআর কমানো, শিথিল শর্তে প্রণোদনার অর্থ দেওয়াসহ নানা নীতি সহায়তা দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, এত আর্থিক প্রতিষ্ঠান দরকার নেই। এখন সময় এসেছে ব্যাংক বা অন্য সবল আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দুর্বল প্রতিষ্ঠানকে একীভূত করে দেওয়া। তারা ব্যাংকের মতো একই রকম পণ্য নিয়ে কাজ করছে। অনেকের পক্ষে ব্যাংকের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, যেসব প্রতিষ্ঠানে অনিয়ম হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংককে সেখানে শক্ত হাতে ব্যবস্থা নিতে হবে। এসব প্রতিষ্ঠানে আরও স্বল্পমেয়াদি আমানত গ্রহণের অনুমতি দেওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া শুধু ঢাকা, চট্টগ্রামে সীমাবদ্ধ না থেকে গ্রামীণ আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রোডাক্ট চালু এবং আমানত সংগ্রহে ব্যাংকনির্ভরতা কমিয়ে বিকল্প উৎস বের করতে হবে।

গত ৩০ জুন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এমডিদের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাত রক্ষায় ব্যাংকগুলো যেন আমানত তুলে না নেয়, সে জন্য একটি নির্দেশনা দেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনো নির্দেশনা দেয়নি। তবে এসব প্রতিষ্ঠান বাঁচাতে প্রণোদনা তহবিল থেকে শিথিল শর্তে দুই হাজার কোটি টাকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ ছাড়া কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান ব্যাংক গ্যারান্টি দিতে পারলে তার বিপরীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে স্বল্পমেয়াদি ঋণ এবং এসব প্রতিষ্ঠানের ঋণ নবায়নের শর্ত শিথিলের আশ্বাস দেওয়া হয়। এর আগে গত ১ জুন থেকে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সিআরআর সংরক্ষণের হার আড়াই শতাংশ থেকে কমিয়ে দেড় শতাংশ করা হয়েছে। এতসব সুবিধা দেওয়া হয়েছে এই খাতকে টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যে। যদিও প্রতিষ্ঠান ব্যাংকের মতো সুদহার কমাতে পারছে না। বর্তমানে এসব প্রতিষ্ঠানের সুদহার রয়েছে ১২ থেকে ১৮ শতাংশ।

বাংলাদেশ লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিএলএফসিএ) চেয়ারম্যান ও আইপিডিসি ফাইন্যান্সের এমডি মমিনুল ইসলাম বলেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংকট কাটাতে গত ৩০ জুন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে বিভিন্ন প্রস্তাব তুলে ধরা হয়। সেখানে দশ হাজার কোটি টাকার একটি তহবিল চাওয়া হলেও আইনগত কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তা দিতে পারছে না। তবে প্রণোদনার পুনঃঅর্থায়ন থেকে দুই হাজার কোটি টাকা প্রি-ফাইন্যান্স দেওয়া, ঋণ নবায়নের শর্ত শিথিলসহ বেশ কয়েকটি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত হয়েছে। অবশ্য যে কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য পুরো খাতের বদনাম হচ্ছে তারা এসব সুবিধা পাবে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের খারাপ কাজের কারণে পুরো আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাত বিপদে পড়েছে। প্রতিনিয়তই আমানত তুলে দেওয়ার জন্য কেউ না কেউ অভিযোগ নিয়ে আসছে। এ রকম অবস্থায় আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাত নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিপদে আছে। তবে পিপলস লিজিং অবসায়ন প্রক্রিয়ার অভিজ্ঞতা থেকে আপাতত কোনো প্রতিষ্ঠান আর অবসায়ন করা হবে না। তবে স্বেচ্ছায় মালিকানা বদল, একীভূত বা অন্য কোনো উপায়ে আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষা করা যায় কিনা তা ভাবা হচ্ছে।

দেশে বর্তমানে ৩৪টি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। খারাপ অবস্থার মধ্যে সম্প্রতি স্ট্র্যাটেজি ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট নামে নতুন আরও একটি প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এমন এক সময়ে এই প্রতিষ্ঠানটি দেওয়া হলো যখন পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস অবসায়নের উদ্যোগ চলমান রয়েছে। গতবছরের ১৪ জুলাই পিপলসের অবসায়ন চেয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আবেদন গ্রহণ করেন আদালত। অনিয়মে জড়িত পরিচালকদের কাছ থেকে ঋণের অর্থ আদায় ও সম্পদ বিক্রি করে আমানতকারীদের অর্থ ফেরতের জন্য অবসায়নের উদ্যোগ নেওয়া হলেও একবছরেও দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। এর বাইরে আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান সঞ্চয়কারীদের অর্থ ঠিকমতো ফেরত না দিলেও বাংলাদেশ ব্যাংক এক প্রকার নীরব। জানা গেছে, পিপলস লিজিংয়ের খারাপ অভিজ্ঞতার কারণে আপাতত আর কোনো প্রতিষ্ঠান অবসায়নের পথে হাঁটবে না বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে নিজ থেকে কোনো প্রতিষ্ঠান একীভূত হতে চাইলে বা মালিকানা বদল করতে চাইলে তাতে সহায়তা দেবে।

আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে দুরবস্থার চিত্র উঠে এসেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদনে। করোনাভাইরাসের প্রভাব শুরুর আগে ২০১৯ সালের তথ্যের ভিত্তিতে প্রস্তুত করা প্রতিবেদনটি সম্প্রতি প্রকাশ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, তাদের আমানতের পরিমাণ আগের বছরের চেয়ে ৩ দশমিক ১০ শতাংশ কমে ৪৫ হাজার ২৩১ কোটি টাকায় নেমেছে। ২০১৯ সাল শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬৭ হাজার ৮০৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে ছয় হাজার ৪৪১ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের সাড়ে ৯ শতাংশ। ২০১৮ সাল শেষে ৬৫ হাজার ৬৮০ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে খেলাপি ছিল পাঁচ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা বা ৭ দশমিক ৯০ শতাংশ। আর সব মিলিয়ে এসব প্রতিষ্ঠানের তিন হাজার ২৮০ কোটি টাকা প্রভিশন সংরক্ষণের বাধ্যবাধকতা থাকলেও রাখতে পেরেছে দুই হাজার ৩৪০ কোটি টাকা। এর মানে ঘাটতি রয়েছে ৯৪০ কোটি টাকা।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ২০১৯ সালে ছয়টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান সিআরআর রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। একটি প্রতিষ্ঠান এসএলআর সংরক্ষণ করতে পারেনি। এসব প্রতিষ্ঠানের নাম সেখানে উল্লেখ করা হয়নি। তবে চলতি বছরের জানুয়ারিতে জাতীয় সংসদে প্রকাশিত ব্যাংকের ঋণখেলাপির তালিকায় ছয়টি প্রতিষ্ঠানের নাম উঠে আসে। এই তালিকায় অবসায়ন প্রক্রিয়ায় থাকা পিপলস লিজিং ছাড়াও নাম রয়েছে- বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি), ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, ফারইস্ট ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট এবং প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট। ঋণখেলাপির তালিকায় থাকা এসব প্রতিষ্ঠানই বেশি সংকটে রয়েছে। এর মধ্যে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, পিপলস লিজিং, এফএএস ফাইন্যান্স ও বিআইএফসির মালিকানায় অস্বাভাবিক পরিবর্তন আসে। এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক এমডি প্রশান্ত কুমার হালদার নানা জালিয়াতির মাধ্যমে এসব প্রতিষ্ঠান থেকে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা বের করে নিয়ে যান বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন প্রতিবেদনে উঠে আসে। পিপলস লিজিং অবসায়ন প্রক্রিয়ার মধ্যে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংকে ঘোরানোর চেষ্টায় গত ২১ জানুয়ারি স্বাধীন পরিচালক ও চেয়ারম্যান হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদকে নিয়োগ দেন আদালত। তবে যে প্রতিষ্ঠানের টাকা পাচার হয়ে গেছে, তা উদ্ধার সম্ভব নয় জানিয়ে এক মাসের মাথায় পদত্যাগ করেন তিনি।

নিউজটি আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন

এই ক্যাটাগরির আর নিউজ
© All rights reserved © vira-l.com 2017-2022
themesba-lates1749691102
Bengali English