আধুনিক বিজ্ঞানের বিস্ময়কর সাফল্য পাশ্চাত্যের লোকদের প্রচণ্ডভাবে মুগ্ধ করেছে। অনেকের মধ্যেই এই মানসিকতা সৃষ্টি হয়েছে যে বিজ্ঞান ধর্মকে চিরতরেই অচল করে দিয়েছে! মনস্তত্ত্ববিদ ও সমাজবিজ্ঞানীদের কেউ কেউ এই অভিমত পোষণ করেন। ইউরোপের প্রসিদ্ধ মনস্তাত্ত্বিক ফ্রয়েড ধর্মের পুনরুজ্জীবন প্রচেষ্টাকে ব্যঙ্গ করে লিখেছেন, ‘মানুষের জীবন স্পষ্টরূপেই তিনটি মনস্তাত্ত্বিক যুগ অতিক্রম করে এসেছে। কুসংস্কারের যুগ, ধর্মের যুগ ও বিজ্ঞানের যুগ। এখন চলছে বিজ্ঞানের যুগ। সুতরাং ধর্মীয় কথাবার্তার এখন আর কোনো গুরুত্ব নেই!’
ধর্মবিরোধিতার মূল কারণ
ধর্ম সম্পর্কে ইউরোপীয় বিজ্ঞানীদের যাবতীয় বিরোধিতার মূল কারণ ছিল ধর্মযাজকদের বিরুদ্ধে তাদের বিরতিহীন সংগ্রাম। এই সংঘর্ষে ধর্মযাজকরা যে কর্মকাণ্ডের বহিঃপ্রকাশ ঘটায় তাতে এরা যুক্তিসংগত কারণেই ভাবতে শুরু করে যে ধর্ম হচ্ছে রক্ষণশীলতা, বর্বরতা, উদ্ভট ধ্যান-ধারণা, অর্থহীন চিন্তা-ভাবনা ও অযৌক্তিক কর্মতৎপরতার সমষ্টি মাত্র। তাই মূল কাজ হলো, ধর্মের জ্ঞানকে চিরতরেই শেষ করে দেওয়া হোক এবং এর স্থলে বিজ্ঞানকে অগ্রসর করে দেওয়া হোক। তাহলেই বিজ্ঞানের আলোকে মানবতা ও মানবীয় সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারা অব্যাহত থাকবে।
ইউরোপের অন্ধ অনুসরণ
মুসলমান নামধারী কিছুসংখ্যক ধর্মবিরোধীর অবস্থা এই যে তারা এই ধর্মবিরোধিতার মূল কারণ বুঝতে সক্ষম নয়, পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের অবস্থা ও পরিবেশের পার্থক্য নির্ণয় করতে সক্ষম নয়। এরা ধর্মের বিরোধিতা করতে থাকে নিরলসভাবে। তাদের এই বিরোধিতা কোনো গভীর চিন্তা বা বিচার-বিশ্লেষণের ফল নয়, বরং ইউরোপের অন্ধ অনুসরণের বাস্তব ফসল। তাদের কাছে ইউরোপের অনুসরণ উন্নতি ও সমৃদ্ধির একমাত্র পথ। এরা ভুলে যায় যে ধর্মের সঙ্গে শত্রুতা করার ক্ষেত্র ইউরোপীয় চিন্তাবিদরা না অতীতে কোনো সময়ে একমত ছিলেন, না বর্তমানে একমত রয়েছেন। তাদের মধ্যে এক উল্লেখযোগ্যসংখ্যক চিন্তাবিদই নাস্তিক্যবাদী সভ্যতার ঘোর বিরোধী! তাঁরা প্রকাশ্যেই ঘোষণা করেছেন যে ধর্ম হলো মানুষের এক অপরিহার্য মনস্তাত্ত্বিক ও যৌক্তিক প্রয়োজন।
ইউরোপীয় চিন্তাবিদদের সাক্ষ্য
ইউরোপীয় চিন্তাবিদদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় ও সবচেয়ে প্রসিদ্ধ হচ্ছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানী জেমস জিনস (James Jeans)। প্রথমে তিনি একজন নাস্তিক ও সংশয়বাদী যুবক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। কিন্তু পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও বৈজ্ঞানিক গবেষণার পর সব শেষে তিনি এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে ধর্ম মানবীয় জীবনের একটি অপরিহার্য প্রয়োজন। কেননা আল্লাহর ওপর ঈমান না এনে বিজ্ঞানের মৌলিক সমস্যাসমূহের সমাধান করা সম্ভব নয়। তিনি জড়বাদ ও আধ্যাত্মিকতার সংমিশ্রণে বিশ্বাস ও আমলের একটি ভারসাম্যপূর্ণ পদ্ধতি রচনাকালে খোলাভাবেই ইসলামের প্রশংসা করেছেন।
ইংল্যান্ডের প্রখ্যাত সাহিত্যিক সমারসেট মম (Somerset Maugham) ধর্ম সম্পর্কে আধুনিক ইউরোপের নেতিবাচক ভূমিকা সম্পর্কে বলেন, ‘ইউরোপ একজন নতুন খোদা সৃষ্টি করেছে। সেই খোদার নাম বিজ্ঞান। এবং তারা পুরনো খোদা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।’
কিন্তু ইউরোপের এই ‘নতুন খোদা’ এক চরম পর্যায়ে বহুরূপী। প্রতি মুহূর্তেই এর রূপ বদলায়। পরের গবেষণা আগের গবেষণাকে মিথ্যা প্রমাণ করে। বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে আজ যা চরম সত্য, কাল তা পরম মিথ্যা। পরিবর্তনের এই চক্র অবিরাম চলছে। ফলে তার পূজারিদের উদ্বেগ ও অস্থিরতাও হরহামেশা চলছে।
শান্তির একমাত্র পথ
ধর্ম ও কেবলমাত্র ধর্মই মানুষকে তার হারানো শান্তি ও নিরাপত্তা ফিরিয়ে দিতে পারে। তার দুঃখের সান্ত্বনা হতে পারে। ধর্মকে বাদ দিলে জীবনের অর্থ বা সারবত্তা বলতে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। ধর্মের মৌলিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আখেরাতের প্রতি বিশ্বাস, এই বিশ্বাসের ফলে মানুষের জীবনে নিত্যনতুন অবকাশের পরশ লেগে যায় এবং আর সামনে নতুন নতুন সম্ভাবনার দিগন্তও উন্মোচিত হয়। নইলে সে হীনম্মন্যতার
যন্ত্রণাদায়ক অনুভূতির নির্মম শিকারে পরিণত হয়।
পারলৌকিক জীবনকে অস্বীকার করার অর্থ হচ্ছে নিজেকে অন্ধ প্রবৃত্তি ও কামনা-বাসনার হাতে ছেড়ে দেওয়া। আরাম-আয়েশের যত উপায়-উপাদান হস্তগত করা তার পক্ষে সম্ভব তার সবটুকুই সে করে। আর এ ক্ষেত্রে হক-হালালের ধার ধারে না। কেউ তার সঙ্গে ভাগ বসাক, তা সে কখনো বরদাশত করে না। এখান থেকেই যাবতীয় শত্রুতা ও পাশবিক সংঘর্ষের সূচনা। একে একে সে প্রবৃত্তির দাসে পরিণত হয়।
এই জড়বাদী মানসিকতার কারণে বিজ্ঞান ও তার আবিষ্কৃত মারণাস্ত্রগুলো মানবজাতিকে শান্তি দেওয়ার চেয়েও ধ্বংস করার কাজে অধিক ব্যবহৃত হয়।
পক্ষান্তরে ধর্মবিশ্বাস মানুষের অন্তরে প্রেম-প্রীতি, স্নেহ-মমতা, ত্যাগ ও পরার্থপরতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে। মানুষের সামনে আশার আলো প্রজ্বলিত রাখে। আখেরাতের ধারণা মানুষকে নিশ্চয়তা দেয়। ফলে তার এই অটল বিশ্বাস জন্মে যায় যে দৈহিক মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তার জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে না, বরং ইহলৌকিক জীবনে কোনো পুরস্কার না পেলেও পরবর্তী পারলৌকিক জীবনে তা সে অবশ্যই লাভ করবে। এ চেতনা মানুষকে ভালো কাজে উদ্বুদ্ধ করে। পরকালে জবাবদিহির ভয়ে সে পাপ থেকে বিরত থাকে। এটি শুধু আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাসের কারণেই হয়ে থাকে।