মঙ্গলবার, ২১ মার্চ ২০২৩, ১১:৩৪ পূর্বাহ্ন

কোভিড-১৯: ৮৫ ভাগ রোগী এমনিতেই ভাল হয়ে যায়

রিপোর্টারের নাম
  • প্রকাশিতঃ রবিবার, ২৮ জুন, ২০২০
  • ৪৮ জন নিউজটি পড়েছেন

গত ১২ জুন অধ্যাপক ডা. গাজী জহির ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। ৩০ মে করোনায় আক্রান্ত হন তিনি।

৪ জুন উপসর্গ তীব্র হওয়ায় হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করলে ৬ মে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে ভর্তির জন্য উদ্যোগ নিই। তার জন্য আইসিইউ সাপোর্ট খুব প্রয়োজন ছিল।

কিন্তু কর্তৃপক্ষ অপারগতা প্রকাশ করায় ৫ জুন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হল তাকে। ৫ জুন রাতে আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। ১২ জুন প্রথম প্রহরে সবাইকে কাঁদিয়ে পরপারে চলে গেলেন প্রাণবন্ত জহির।

বড় করুণ এই মৃত্যু। যে প্রতিষ্ঠানে আজীবন রোগীর সেবা দিয়ে এসেছেন সে প্রতিষ্ঠানে নিজে রোগী হিসাবে ঠাঁই পায়নি।

এছাড়া মরহুম কিবরিয়া স্যার করেনায় আক্রান্ত হয়ে সিএমএইচে মারা গেলেন। শ্রদ্ধাভাজন রাজনীতিবিদ মোহাম্মদ নাসিম এমপি, সিলেট সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র বদরুদ্দিন কামরান, ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ আবদুল্লাহ- আরও কত মানুষ অকালে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে গেলেন।

মৃত্যুর এ মিছিল দীর্ঘ। কতকাল আরও কত লাশের বোঝা বইতে হবে মহান সৃষ্টিকর্তাই ভালো জানেন। বড় করুণ বড় নির্মম এ মৃত্যু।

এক অদৃশ্য শক্তি, প্রাণহীন অনুজীব চীনের উহান থেকে যার যাত্রা শুরু, সেখানকার বন্য প্রাণীর বাজারের বাদুর থেকে। আবার কারও মতে উহানের ইন্সটিটিউট অব ভাইরোলজি থকে মানুষের মধ্যে তা সংক্রমিত হয়।

মানুষের নাক, মুখ বা চোখ দিয়ে শরীরে প্রবেশ করে আক্রান্ত করে প্রথমে হালকা জ্বর, হাঁচি-কাশি, গা ম্যাজ ম্যাজ করা, শ্বাসতন্ত্রকে আক্রমণ করা, কেউ বা উপসর্গহীন।

অনুজীবটি মুকুটের মত দেখতে তাই এর নাম করোনাভাইরাস। এর আগে একই গোত্রের সার্স যা ২০০৩ সালে মহামারী আকারে এসেছিল। সেজন্য করোনাকে সার্স কোভ-২ ও বলা হয়। নতুন এসেছে বলে এর নাম নভেল করোনা ভাইরাস বা কোভিড-১৯।

গত বছরের শেষ দিকে যার জন্ম। মুহূর্তের মধ্যেই দাবানলের মতো চীন থেকে যাত্রা শুরু করে ইউরোপের ইটালি, স্পেন, যুক্তরাজ্য হয়ে যুক্তরাষ্ট্র, ল্যাটিন আমেরিকা, ব্রাজিল হয়ে দক্ষিণ এশিয়া ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশেও এ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে।

প্রতিদিন মৃত্যু আর আক্রান্তের হার বাড়ছে। ভাইরাসটি ক্রমেই অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে। ক্ষুদ্র অনুজীব অথচ ভয়ঙ্কর সব মারণাস্ত্র এর কাছে নস্যি। এই বৈশ্বিক করোনা মহামারী (প্যানডেমিক) যা এর আগে মানুষ আর কখনো দেখেনি।

প্লেগ, স্পানিশ ফ্লু, কলেরা, ইবোলা, এইডস, বার্ড ফ্লু, নিপা ভাইরাস- বিভিন্ন সময়ে আত্মপ্রকাশ করলেও নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চল বা জনগোষ্ঠীকে আক্রান্ত করেছে। কিন্তু করোনাভাইরাস দ্রুত সময়ে পৃথিবীর প্রায় সব এলাকায় সংক্রমিত হয়েছে।

একমাত্র নিউজিল্যান্ড ও ভিয়েতনাম ছাড়া আর কোনো দেশ এই ভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। কবে পারবে তা কেবল মহান সৃষ্টিকর্তাই বলতে পারেন।

করোনা একটি আতঙ্কের নাম। রোগটি যতটা ছোঁয়াচে ততটা কিন্তু ভয়ঙ্কর নয়। কিন্তু এক ধরনের ভীতি আর আতঙ্কের কারণে রোগটি প্রতিটি মানুষের মনে হতাশা তৈরি করেছে।

বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ১ লাখ ৩০ হাজারের বেশি মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। প্রায় ১৭০০ জন মারা গেছেন। অনুজীবটি শ্বাসনালীতে প্রবেশ করে সক্রিয় হয়।

যে সব কোষে ACE-2 এনজাইম থাকে সেখানে ভাইরাসটি আক্রমণ করে। বাইরের আস্তরণ খসে যায় এবং RNA সক্রিয় হয় ও বংশবৃদ্ধি করে নতুন নতুন কোষকে আক্রান্ত করে।

ভাইরাসটি কোষের এনডোজমে অবস্থান নেয়। ভাইরাসের খসে যাওয়া আস্তর মৃতকোষ আর গলিত অংশে ফুসফুসের এলাভিওলাই পরিপূর্ণ হয়ে ফুসফুস আকার্যকর করে। শ্বাস কষ্ট, অক্সিজেন স্বল্পতা আর নিউমোনিয়া তীব্র হয়।

রক্ত জমাট বাঁধে এবং রক্তনালীর দেয়ালের ছিদ্র প্রসারিত হয়ে রস বের হয়ে ফুসফুসের ফাঁপা অংশ পূর্ণ হয়ে ফুসফুসের প্রসারণ সংকুচিত করে। হৃদযন্ত্র অকার্যকর হয়। প্রয়োজনীয় চিকিৎসার অভাবে মানুষ মারা যায়।

এখন আসা যাক করোনা রোগী কেন ভীতিকর। রেডিও, টিভি আর সংবাদপত্রের কল্যাণে রোগটি এত আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। এ রোগে আক্রান্ত হলে পরিবার, সমাজ- সবার কাছে সে অবহেলার পাত্র আর অচ্ছুৎ হয়ে যায়।

কেউ তাকে দেখতে আসে না, ছুঁতে চায় না, সেবা ও চিকিৎসা দিতে অনীহা প্রকাশ করে। সে জন্য এ রোগে আক্রান্ত হলে এক ধরনের ভীতি রোগীকে কুরে কুরে খায়। রোগী সুস্থ হওয়ার পরিবর্তে আরও অসুস্থ হয়ে যায়।

আসলেই কি রোগটি ভীতিকর? পরিসংখ্যান বলছে, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর শতকরা ১৫ জনকে হাসপতালে ভর্তি হতে হয়। শতকরা ১০ জনের জন্য আইসিইউ প্রয়োজন হয়।

করোনা আক্রান্ত রোগীদের সবার উপসর্গ থাকে না। রোগটি শনাক্ত হলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা করাতে হবে। মনোবল অটুট রাখতে হবে। আতঙ্ক বা ভয় নয়, সাহসের সঙ্গে মোকাবেলা করতে হবে।

বাংলাদেশ একটি ঘনবসতিপূর্ণ দরিদ্র দেশ। এখানে প্রয়োজনীয় শিক্ষা নেই, শৃঙ্খলা নেই। নিয়ম মানার প্রবণতা নেই। প্রয়োজনীয় পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই। সচেতনতা নেই। হাসপাতালের বিছানা নেই।

মহামারী নিয়ন্ত্রণে যেভাবে আন্তরিকতা নিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা দরকার তেমন আন্তরিকতা নিয়ে এগিয়ে আসার মত চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী নেই।

আগেই বলেছি, ভাইরাসটি নাক, মুখ ও চোখ দিয়ে প্রবেশ করে। এজন্য হাত বারে বারে সাবান বা স্যানিটাইজার দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে। নাকে মুখে মাস্ক পরতে হবে- তা কাগজের বা কাপড়ের হলেই হল। চোখে চশমা।

হাত না ধুয়ে নাক, মুখ বা চোখ স্পর্শ করা যাবে না। যেখানে সেখানে কফ থুথু ফেলা যাবে না। ব্যবহৃত রুমাল বা টিস্যু, মাস্ক ফেলা যাবে না। রুমাল বা টিস্যু না থাকলে কনুই দিয়ে নাক মুখ ঢেকে হাঁচি-কাঁশি দিতে হবে। মাস্ক ছাড়া বের হওয়া যাবে না।

এসব ব্যবস্থা নিলেই ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধ সম্ভব। আহেতুক দামী নভোচারী পোশাক, উচ্চমূল্যের মাস্ক, ক্যাপ, গগলস, গ্লাভস ব্যবহার রোগীর চিকিৎসার পূর্বশর্ত হতে পারে না।

মনে রাখতে হবে, চিকিৎসার নামে উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা বা অর্থ খরচ করা যাবে না। সরকারের বিপুল বাজেট নষ্ট করে এ দুঃসময়েও ‘কারও ঘর পোড়ে আর তাতে আলু পোড়া দিয়ে খাওয়ার’ প্রবণতা দুঃখজনক।

কোভিড-১৯ ভাইরাসটি বেশি বেশি পরীক্ষা করে শনাক্ত করতে হবে। আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পর্যাপ্ত কোভিড-১৯ রোগীর চিকিৎসার সুযোগ সম্প্রসারিত করতে হবে।

পাশাপাশি সাধারণ রোগী ও যেন করোনার অযুহাতে চিকিৎসা বঞ্চিত না হয় সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনীয় ঔষধ সরবরাহ থাকতে হবে। জেলা হাসপাতালগুলোতে আইসিইউর ব্যবস্থা রাখতে হবে।
বেসরকারি হাসপাতালে ও কোভিড রোগীর চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা রাখতে হবে, চিকিৎসা ব্যয় নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। হাসপাতাল ও রোগীর চিকিৎসা-সংশ্লিষ্ট সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

ক্লিনিক, হাসপাতাল ও চিকিৎসা সেবা কর্মীদের উপর ভাংচুর, হামলার বিরুদ্ধে আইন করে শাস্তির ব্যবস্থা রাখতে হবে।

কোভিড-১৯ এর নিয়ন্ত্রণ ত্বরান্বিত করতে হলে আমাদের সবাইকে আন্তরিকতার সঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে। বেশ কিছু দেশ রোগটির ভ্যাকসিন আবিস্কারে উঠেপড়ে লেগেছে। বেশ কিছু ট্রায়াল হয়েছে, কিছু অগ্রগতি হয়েছে।

১. আমাদের দেশে বিশেষ করে ঢাকা ও চট্টগ্রামে এখন করোনা সংক্রমণ চরম সীমায়। সংক্রমিতদের প্রায় ৮৫% এমনিতেই ভাল হয়ে যায়, কিন্তু তাদের দ্বারা অন্যরা যেন সংক্রমিত না হয় এজন্য সর্তক হতে হবে।
যাদের বয়স ৫০ এর ওপর এবং যাদের কো-মরবিডিটি অর্থাৎ অন্য রোগ যেমন শ্বাস-প্রশ্বাসের কষ্ট, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ আছে তাদের মৃত্যুঝুঁকি অনেক বেশি।

২. রুল অফ থাম্ব অনুযায়ী আক্রান্তের ১৫ শতাংশের হাসপাতাল লাগে, অর্থাৎ যদি ১ লক্ষ ৩০ হাজার সংক্রমিত হয়, তা হলে ২০ হাজার রোগীর জন্যে হাসপাতালের বিছানা লাগে, ১০% ICU লাগে (১৩ হাজার ICU বেড) ও প্রায় ৫% (৭,৫০০) রোগীর কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্যে ভেন্টিলেটর বা ওই জাতীয় যন্ত্র লাগে।
কিন্তু তারপরও এই ৫% ক্রিটিকাল রোগীকে বাঁচানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।

৩. শুধু বেড হলেই কি হয়, সাথে উপযুক্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ডাক্তার ও জনবল লাগে। উপরে উল্লেখিত প্রয়োজনীয় রসদ ও জনবলের সামান্য অংশও আমাদের দেশে এই মুহূর্তে নেই।

সুতরাং সরকার ঘোষিত স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলে জনগণের জীবন বাঁচাতে হবে।

৪. জ্বর ১০২ থেকে ১০৩ ডিগ্রি দুই থেকে তিন দিন, তারপরই মারাত্মক দুর্বলতা, তীব্র গলা ব্যথা যার কারণে কথা বলতে পারছেন না- এ ৩টি উপসর্গ দেখা দিলে তিনি করোনার টেস্ট করাবেন এবং চিকিৎসা নেবেন।

৫. এই নভেল করোনাভাইরাস আমাদের প্রতি বছর হয়ে যাওয়া ইনফ্লুয়েঞ্জার সমগোত্রীয়। করোনার উপসর্গ আর ইনফ্লুয়েঞ্জার উপসর্গ ৯০% প্রায়ই একই রকম। তাই এই ধরনের উপসর্গ হলেই করোনা টেস্ট করার কোনো প্রয়োজন নেই।

নিজের বাড়িতে সামাজিক ও পারিবারিক দূরত্ব মেনে চলুন। ১৪ দিন পর জ্বর, কাশি বা শ্বাসকষ্ট না থাকলে আপনি মনে করবেন আপনি করোনা বা ইনফ্লুয়েঞ্জা মুক্ত। কিন্তু সর্বসাধারণের করোনা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতেই হবে।

মনে রাখবেন, ৪নং অনুচ্ছেদে বর্ণিত উপসর্গ না থাকলে আপনি করোনা টেস্ট করতে যাবেন না। কারণ তা শুধু অপ্রয়োজনীয়ই নয়, আপনার জন্য আসল করোনা রোগীর টেস্টে দেরি হবে ও একটি করোনা টেস্ট কিট খামোখা নষ্ট হবে। এই কিট বাইরে থেকে আনতে হয়। আর এই কিট আনতে সময় লাগে।

৬. প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে ক) ট্যাবলেট জিঙ্ক, ভিটামিন-সি, ভিটামিন-ডি ও ক্যালসিয়াম খাবেন, খ) আমিষ প্রধান খাদ্য যেমন- ডিম, মাছ ও মাংসের সঙ্গে সামান্য তরকারিও খাবেন। আম, কাঠাল ও অন্যান্য দেশি ফল যত পারেন খাবেন (কামরাঙ্গা ছাড়া) কিন্তু তা মূল খাবারের পরে।

৭. জরুরি প্রয়োজনে মাস্ক পরে বাইরে যাবেন। বাসায় ফিরেই হাত ধোবেন। স্যানিটাইজার বা সাবান দিয়ে বারবার হাত পরিষ্কার করবেন। মাস্ক ও চশমা ছাড়া ঘরের বাইরে বের হবেন না। কাপড়ের মাস্ক হলে বাসায় এসেই তা ধুয়ে পরিষ্কার করে আবার ব্যবহার করতে পারবেন।

সবশেষে, আশা করি দ্রুত করোনার ভ্যাকসিন বাজারে আসবে। ততদিন সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা, ধরিত্রীকে এ ভয়ঙ্কর বিপদ থেকে রক্ষা করুন।

লেখক: অতিরিক্ত পরিচালক (হাসপাতাল) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, শাহবাগ, ঢাকা।

নিউজটি আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন

এই ক্যাটাগরির আর নিউজ
© All rights reserved © vira-l.com 2017-2022
themesba-lates1749691102
Bengali English