আকবর হোসেন পাঠান ফারুক। চিত্রনায়ক হিসেবে তার সফল একটি সোনালি অতীত রয়েছে। এখন অভিনয় না করলেও সিনেমার বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে তার উপস্থিতি লক্ষণীয়। অন্যদিকে চিত্রনায়িকা রোজিনাও সেই সময়েরই একজন সফল শিল্পী।
এ দু’জন জুটি বেঁধে বেশ কিছু ছবিতে একসঙ্গে অভিনয় করে সাফল্যের ফসল ঘরে তুলেছেন। বর্তমানে ছবিতে একসঙ্গে দেখা না গেলেও আগের মতোই যোগাযোগ রয়েছে তাদের মধ্যে। সম্প্রতি নিজেদের সোনালি অতীত নিয়ে গল্পে আড্ডায় মেতেছেন এ দুই তারকা।
আষাঢ়ের বৃষ্টিস্নাত এক বিকেল। প্রকৃতির সজীবতায় ফুরফুরে হাওয়া বইছে। করোনাভাইরাসের প্রভাবে বাইরে যাওয়াই মুশকিল। গুরুত্বপূর্ণ অনেক ব্যক্তিকে ঘরে বসেই করতে হচ্ছে অনেক কাজ। তাদেরই একজন এক সময়ের সফল চিত্রনায়ক ও বর্তমান সংসদ সদস্য ফারুক। নিজ সংসদীয় এলাকার কাজের পাশাপাশি ঢাকাই ছবির ভালো-মন্দও তাকে দেখভাল করতে হয় বিশিষ্টজনদের অনুরোধে। তাই ঘরে থাকলেও অবসরের ফুরসত নেই।
অন্যদিকে তারই সময়কার একজন জনপ্রিয় চিত্রনায়িকা রোজিনা। লন্ডন ও ঢাকা- এভাবেই তার দিন কেটে যায়। যতদিন ঢাকায় থাকেন পুরনো স্মৃতি হাতড়ে বেড়ান ঢাকাই ছবিতেই। করোনাকালে তিনি ঢাকাতেই আছেন। অন্যসবার মতো ঘরবন্দি।
কথা ছিল এ দুই তারকাকে নিয়ে মুখোমুখি এক জম্পেশ আড্ডার। কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি মেনে সেটা করা বেশ মুশকিল। বাধ্য হয়েই প্রযুক্তির শরণাপন্ন হওয়া। মোবাইল ফোনেই হবে আড্ডা। আগে থেকে নির্ধারিত সময়ে ফারুককে ফোন দিতেই ওপ্রান্ত থেকে গম্ভীর গলায় বললেন ‘হ্যালো’। শুরুতেই জানতে চাইলেন রোজিনার কথা। তিনিও প্রস্তুত আছেন জানতে পেরে অপেক্ষায় থাকলেন। ততক্ষণে ফোনে যুক্ত হলেন রোজিনাও। শুরু হল স্মৃতিচারণ।
ফারুক জনপ্রতিনিধি হিসেবে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন; কিন্তু সিনেমা কিংবা অভিনয় সংক্রান্ত বিষয়ের অবতারণা করলে তিনি সব কিছু ভুলে আগ্রহী হয়ে ওঠেন সেই বিষয়ে কথা বলতে। অন্যদিকে রোজিনা এখন অভিনয় না করলেও কিছু সামাজিক কার্যক্রম নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। একটু পেছন ফিরে তাকালে দেখা যায়, স্বাধীনতার পর ঢাকাই ছবি যে সময় কর্মচাঞ্চল্যতায় মুখর হয়ে উঠছিল, ঠিক সে সময়ই অভিনয় রসায়নে অনবদ্য এক জুটি হিসেবে আবির্ভাব ঘটে ফারুক-রোজিনার। তাদের নিয়ে সে সময় সবচেয়ে বেশি ছবি বানিয়েছিলেন নারায়ণ ঘোষ মিতা। আর ছবিগুলোও দর্শকের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল।
‘সুখের সংসার’, ‘জনতা এক্সপ্রেস’, ‘তাসের ঘর’, ‘মান অভিমান’, ‘সাহেব’সহ প্রায় পঞ্চাশটির মতো ছবিতে জুটি হিসেবে দেখা গেছে ফারুক ও রোজিনাকে। কয়েক বছর বেশ দাপটের সঙ্গেই তারা জুটি বেঁধে সিনেমার পর্দা কাঁপিয়েছেন। এ জুটির অন্যতম কুশীলব ফারুক বলেন, ‘জুটি বলেন আর যাই বলেন, এটা ভেবে কখনই কাজ করিনি। একাধিক ছবিতে অভিনয় করার কারণে কখন যে জুটি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছি, তা অগোচরেই হয়েছে। বিশেষ করে রোজিনার সঙ্গে এভাবেই কাজ করা হয়েছে। আমি কিন্তু প্রায় সব হিট নায়িকার সঙ্গেই অভিনয় করেছিলাম।’
এ পরিপ্রেক্ষিতে রোজিনার বক্তব্য একটু আলাদা। বিষয়টি তিনি পরিষ্কার করে বলেন, “ক্যারিয়ারের শুরুতে ছোট চরিত্রে কিছু ছবিতে অভিনয় করেছি আমি। কিন্তু ‘রাজমহল’ নামের ছবিটি আমার অভিনয় জীবনের গতিপথ ঠিক করে দেয়। এ ছবির কারণে একক নায়িকা হিসেবে প্রচুর কাজের প্রস্তাব আসতে থাকে। পরিচিতির পাশাপাশি তারকাখ্যাতি তখন থেকেই পাওয়া শুরু করি। এরপর ফারুক ভাইয়ের সঙ্গে অভিনয় শুরু করি। পরে আমার ক্যারিয়ারের বেশিরভাগ সফল ছবির নায়ক হিসেবে ফারুক ভাইকে পেয়েছি। দর্শকও আমাদের দারুণভাবে গ্রহণ করেন।’ এ কথা বলেই বেশ উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন রোজিনা।
সঙ্গে আরও যোগ করেন, ‘শুধু পর্দার হিরো নয়, বাস্তব জীবনেও তাকে আমার হিরো মনে করি।’ বলেই মিষ্টি একটি হাসি দিয়ে প্রসঙ্গ পরিবর্তন করেন চিত্রনায়িকা। ততক্ষণে ফোনের আরেক প্রান্ত থেকে হো হো করে হেসে ওঠেন ফারুক। তিনিও রোজিনার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কথার বাঁক ঘুরিয়ে চলে যান রোজিনার ছবিতে কাজ শুরু করার দিনগুলোর কথায়।
তিনি বলেন, ‘রাজবাড়ীর মতো একটি মফস্বল এলাকা থেকে রাজধানী ঢাকায় এসে একা একা সারভাইভ করে ছবিতে জায়গা করে নেয়া সহজ কথা নয়। কিন্তু রোজিনা সেই অসম্ভব কাজটি করেই আজকের এ জায়গায় এসেছে। আমার জানা মতে তখন এমন স্ট্রাগল করে কেউই বড় তারকা হননি। তাই ওর প্রতি আমার স্নেহ সব সময়ই থাকত। আমি পরিশ্রমী মানুষদের পছন্দ করি। রোজিনার জীবন সংগ্রামের কাহিনীও আমার জানা। ব্যক্তিগত জীবনেও সে অত্যন্ত দায়িত্বশীল একজন মানুষ।’ ঠিক এই কথার রেশ ধরেই রোজিনা বলেন, ‘ফারুক ভাইয়ের মতো একজন সহশিল্পী, দায়িত্বশীল মানুষের সহযোগিতা পেয়েছিলাম সে সময়টায়, যা আমার আজীবন মনে থাকবে।’
ফারুক কিন্তু তখনও রোজিনার প্রশংসা করে চলছেন- ‘রোজিনার ব্যবহার, সুন্দর করে কথা বলা এবং সর্বোপরি মানুষের সঙ্গে সাবলীলভাবে যোগাযোগ রক্ষা করে চলাটা আমাকে অভিভূত করে, যা খুব কম মানুষেরই আছে। একজন বড় তারকা হতে গেলে যেসব মানবীয় গুণাবলীর দরকার হয়, তার প্রায় সবটুকুই আছে তার মধ্যে। আমরা যখন নিয়মিত ছবিতে অভিনয় করতাম, তখন পত্রপত্রিকায়ও আমাদের অভিনয় রসায়নের বিষয় নিয়ে ইতিবাচক সংবাদ প্রকাশ হতো।’ রোজিনাও কম যান না। ফারুকের কথার রেশ ধরে বলেন, ‘ফারুক ভাই যে কত বড় মাপের ও মনের মানুষ তা আমি কথায় প্রকাশ করতে পারব না। তার কিছু সমালোচনাকারী বলত, ফারুক সাহেব শুধু গ্রামের চরিত্রে সফল। কিন্তু আমি জানি যে তিনি সব ধরনের চরিত্রেই সফলভাবে অভিনয় করেছেন। যাদের জনপ্রিয়তা বেশি, তাদের কিছু সমালোচনাকারী তো থাকবেই।’
রোজিনার সঙ্গে কাজ শুরুর সময় সম্পর্কে ফারুক বলেন, ‘আমাদের প্রোডাকশনের সঙ্গে যখন রোজিনার কাজ শুরু হয় তখন সে দ্বিতীয় চরিত্রে অভিনয় করত। কিছুদিন যাওয়ার পরই একক নায়িকা হিসেবে কাজ শুরু করে। আমি বলব একটি সংগ্রামী জীবনই ছিল রোজিনার। অনেক প্রতিকূলতাকে মোকাবেলা করেই তাকে কাজ করতে হয়েছে। তবে সে দমে যায়নি কখনই। হয়তো পর্দার বাইরে তার কর্মকাণ্ডগুলো অনেকেরই অজানা।
সে জায়গাতে একজন মানবিক মানুষ হিসেবে আমি তাকে জানি। রাজবাড়ীর নিজের এলাকায় সামাজিক অনেক বিষয়ে তার কার্যক্রম রয়েছে। বর্তমানে সেখানে নিজস্ব অর্থায়নে একটি মসজিদ বানাচ্ছে। এ কথা শোনার পর তার প্রতি আমার দৃষ্টিভঙ্গি আরও উন্নত হয়েছে। সে নিজে থেকে এ খবর জানায়নি। ঘটনাক্রমে আমি জেনেছি চলতি বছরের শুরুর দিকে।’
কথায় কথায় আড্ডা জমে যায়। স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন দু’জনেই। গল্পে আড্ডায় এ দুই তারকার কাজ ও ব্যক্তি জীবনের অনেক কথাই জানা যায়। তবে আশি কিংবা নব্বইয়ের দশকের সিনেমা অঙ্গন আর এখনকার সিনেমা অঙ্গনের পার্থক্যের কথা দুই তারকাই অকপটে বলেছেন। আগে কোনো কোনো ছবি এক বছর পর্যন্ত প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত হতো। আর এখন কয়েক মাসও চলছে না। এ থেকে উত্তরণের জন্য দায়িত্বশীলদের প্রতি কাজ করার আহ্বান জানান দু’জনেই।