ভারতের সীমান্তবর্তী বিভিন্ন এলাকা চীন দখল করে নিচ্ছে আর তা উপেক্ষা করে চলেছেন বলে নিজ দলের এক নেতার বিরল ও বিস্ফোরক অভিযোগের মুখোমুখি হয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ১শ’ ৪০ কোটি জনসংখ্যার দেশটিতে ক্ষোভ বৃদ্ধি পায় মে মাসের গোড়ার দিকে যখন লাদাখের ৬০ বর্গকিলোমিটার জমি চীনের সেনাবাহিনী দখল করে নিয়েছে বলে খবর প্রকাশিত হয়।
গালওয়ান উপত্যকায় গত সপ্তাহে চীনা স্থাপনা উচ্ছেদের চেষ্টাকালে কমপক্ষে ২৩ জন ভারতীয় সেনা হাতাহাতি নিষ্ঠুর লড়াইয়ে মারা যায়। লাদাখের ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) কাউন্সিলর উর্গাইন চোদন টেলিগ্রাফকে বলেছেন যে, চীন এর আগে প্রকাশিত খবরের চেয়ে অনেক বেশি জমি দখল করেছে এবং সরকার অন্ধ হয়ে রয়েছে।
আটটি সীমান্তবর্তী গ্রামের প্রতিনিধিত্বকারী মিস উর্গাইন বলেছেন, ‘গালওয়ান উপত্যকায় কেবল এই সময়ই নয়, চীন এর আগেও এলএসি’র প্রচুর জমি দখলে নিয়েছে’। ‘আমি এ বিষয়টি উত্থাপন করেছি ও স্থানীয় প্রশাসনের সাথে বৈঠক করে চলেছি। তারা এ সম্পর্কে জানে, কিন্তু সরকার বা গণমাধ্যম দু’পক্ষই এ নিয়ে কোনও আওয়াজ তোলেনি’। এ সপ্তাহে সীমান্তে শান্তিপূর্ণভাবে উত্তেজনা হ্রাস করার লক্ষ্যে আলোচনা চলছিল, তবে শুক্রবার মোদি তার বিরোধী পক্ষের সমালোচনার শিকার হন এ কথা বলার কারণে যে, বিবদমান অঞ্চলটি কখনই ভারতের অংশ ছিল না।
জমিটি সবসময়ই চীনের ছিল বলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বক্তব্য প্রশ্নে মিস উর্গাইন বলেন, ‘[সরকার] মিথ্যা বলছে, তারা যা বলছে তা সত্য নয়’। কাউন্সিলরের বক্তব্যে লাদাখ সঙ্কট মোকাবিলার পদ্ধতি নিয়ে দলটির মধ্যে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে এবং বিজেপির মধ্যে শৃঙ্খলার ঐতিহ্যকে ভেঙে দেয়।
মি. মোদির চীন নিয়ে সমঝোতার পদ্ধতির বিষয়ে উদ্বেগের লক্ষণ গত সপ্তাহের শেষদিকে উত্থাপিত হয় লাদাখের বিজেপির সাংসদ জামায়াং ত্রেসিং নামগিয়ালের মুখ থেকে। তিনি প্রতিশোধ গ্রহণসহ চাইনিজ জমি দখল করে চ্যালেঞ্জের ‘এককালীন সমাধান’ করার দাবি করেছিলেন।
বিরোধী কংগ্রেস দল মি. মোদির প্রতিক্রিয়া নিয়ে তীব্র সমালোচনা করেছে। প্রাক্তন নেতা রাহুল গান্ধী বলেছেন, চীনা সৈন্যরা নখের মতো ব্যাট হাতে ভারতীয় সৈন্যদের মেরে ফেলার পরে তিনি ‘যুদ্ধাপরাধ’ উপেক্ষা করছেন। তবে এ মিস উর্গাইনের দাবি প্রধানমন্ত্রীকে সবচেয়ে বেশি প্রেসার সৃষ্টি করবে, যখন সরকার দেশজুড়ে করোনভাইরাস সংক্রমণ মোকাবেলায় লড়াই করছে। মিস উর্গাইন২০১২ সালের নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিলেন।
তিনি বলেন, তার পরিবার বহু বছর ধরে চারণভ‚মি হিসেবে ব্যবহার করে আসছে কোয়েলের এমন প্রত্যন্ত জমি দু’বছর আগে চীনারা দখল করে নেয়। তিনি টেলিগ্রাফকে বলেন, সেনাবাহিনী যখন সেখানে প্রবেশ করল, পরিবার যে ইয়াকগুলি অর্থ উপার্জনের জন্য বিক্রি করত, সেগুলোও উদ্ধার করতে পারেনি।
‘জমি সঙ্কুচিত হওয়ার ফলে স্থানীয় লোকজন ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে, যারা প্রকৃতপক্ষে এই অঞ্চলগুলোতে তাদের পশুপাল চরানোর মাধ্যমে সীমান্ত রক্ষা করছিল। প্রাথমিকভাবে এমনকি ভারতীয় সেনাবাহিনী তাদের এ অঞ্চল থেকে থামিয়ে দিয়েছিল এবং পরে বছরের পর বছর ধরে চীনারা এই অঞ্চলগুলোতে নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। আমার বাবা গরু নিয়ে নীলংয়ে একটি বড় উপত্যকায় যেতেন তবে আজ সেখানে চীনা কাঠামো এবং তাদের সেনাবাহিনী রয়েছে। আমাদের চারণভ‚মি চলে গেছে, প্রচুর লোক তাদের পশুপাল হারাচ্ছে। কেউ কেউ এখন তাদের গবাদি পশু বিক্রি করে অন্য কোনও কাজ সন্ধানের জন্য শহরের দিকে এগিয়ে চলেছে’।
নীলং ছাড়াও, মিস উর্গাইন পূর্বের নিয়ন্ত্রণাধীন অঞ্চল হিসাবে লেগোক নুন্বো, ডুমচালাই এবং বেলুঙ্গকে চিহ্নিত করেন যেগুলোতে আগে রাখালরা ঘুরে বেড়িয়েছে, কিন্তু এখন চীনের নিয়ন্ত্রণে। তিনি বলেন যে, সেনাবাহিনী ও সরকারকে সতর্ক করা সত্তে¡ও জবাব মেলেনি, যদিও উভয়েই অবগত ছিল যে, বেইজিং এ অঞ্চলে রাস্তা ও কাঠামো নির্মাণ করায় চীনা দখল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
লাদাখের প্রধান শহর লেহ শহরের কংগ্রেস সভাপতি ত্রেসিং নামগিয়াল টেলিগ্রাফকে নিশ্চিত করেছেন যে, চীন জমি অধিগ্রহণ করেছে।
মি. নামগিয়াল বলেন. ‘চীনারা কয়েকটি মূল অবস্থান দখল করেছে। এটি তাদের একটি সুচিন্তিত এবং পরিকল্পিত কৌশল। তারা পেট্রোলিং পয়েন্ট ১৪, একটি পর্যবেক্ষণকারী পোস্ট দখল করেছে, যার অর্থ তারা উচ্চতায় রয়েছে এবং একটি বিস্তৃত অঞ্চলকে পর্যবেক্ষণ করতে পারবে’।
আরো সৈন্য ও যুদ্ধবিমান পাঠিয়েছে ভারত
রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে ২০ জন ভারতীয় সেনা নিহত হওয়ার পরে ভারত যুদ্ধবিমান স্থাপন করেছে এবং চীনের সাথে বিতর্কিত সীমান্ত অঞ্চলে আরও সেনা পাঠিয়েছে। উভয় পক্ষের পক্ষ থেকে এই অঞ্চল থেকে সেনা প্রত্যাহার করার ঘোষণা দেয়া সত্তে¡ও সামরিক শক্তি প্রদর্শনের একটি উপায় হিসাবে – ভারতীয় জঙ্গি বিমানগুলি হিমালয়ের ফ্ল্যাশপয়েন্টের উপরে গর্জন করেছে।
উভয় পক্ষের সেনা কর্মকর্তারা পশ্চিম হিমালয়ের লাদাখ অঞ্চল থেকে সেনা নিষ্ক্রিয় করতে সম্মত হওয়ার ঠিক একদিন পরেই এই বৈরিতা দেখা দেয়। চীনা বাহিনী ১৫ জুন এই মারাত্মক লড়াইয়ের পর গালওয়ান উপত্যকার মুখে কয়েক বর্গ মাইল জুড়ে এক বিশাল জমি নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। রক্তক্ষয়ী সহিংসতায় কমপক্ষে ২০ জন ভারতীয় সেনা মারা গিয়েছিল। তা সত্তে¡ও বুধবার ভারতীয় জেটগুলি নিয়মিতভাবে বিবদমান অঞ্চলের প্রধান ভারতীয় শহর লেহ-এর একটি সামরিক ঘাঁটি থেকে দেড়শ’ মাইল দ‚রে পাহাড়ী সীমান্তের দিকে যাত্রা করে। লেহ থেকে বেরিয়ে প্রধান রাস্তায় চেকপয়েন্ট এবং মূল শহরটির আশেপাশে সামরিক কর্মতৎপরতা ছিল। এটি ৩,৫০০ মিটার দূরে অবস্থিত। বাসিন্দারা লেহের কাছাকাছি রাস্তায় লম্বা লাইনে সামরিক ট্রাক ও আর্টিলারিও দেখেছেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীর নর্দান কমান্ডের এক নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তা এএফপিকে বলেছেন : ‘এলাকায় এখন আমাদের ভাল শক্তি উপস্থিত রয়েছে’।
চীনা পণ্য বর্জন সম্ভব নয় : ভারতীয় এক্সপোর্ট প্রমোশন গ্রুপ
বৃহস্পতিবার ভারতের শীর্ষ এক্সপোর্ট প্রমোশন গ্রুপ জানিয়েছে, চীন থেকে পণ্য বর্জন করা সম্ভব হবে না, কারণ ভারত এ জাতীয় আমদানির উপর নির্ভরশীল, যদিও নয়াদিল্লির উচিত তাদের উপর নির্ভরতা হ্রাস করার চেষ্টা করা। প্রতিবেশীদের মধ্যে সীমান্তের সংঘর্ষে ২০ জন ভারতীয় সেনা নিহত হওয়ার পরে ভারতে চীনা পণ্য বন্ধ করার আহবান যেমন বেড়েছে, তখন চেন্নাইয়ের মূল বন্দরের শুল্ক কর্মকর্তারা অতিরিক্ত চেকের জন্য চীন থেকে আগত চালান ধরে রেখেছেন।
ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান এক্সপোর্ট অর্গানাইজেশনসের সভাপতি (এফআইইইও) শারদ কুমার সরফ বলেছেন, ‘সা¤প্রতিক সময়ে চীনের সাথে সঙ্ঘাতের সময়ে ভারতকে স্বাবলম্বী করতে আমরা সরকারকে আমাদের সমর্থন জানাই, তবে আমাদের এও মনে রাখা উচিত যে, আমরা প্রচুর মূল কাঁচামালের জন্য চীনের উপর নির্ভরশীল’। সরফ সাংবাদিকদের বলেন, সরকারের উচিত ভারতীয়দের তৈরি করা চীনা আইটেম কেনা বন্ধ করতে বলা, তবে সব চীনা পণ্য নিষিদ্ধ বা বর্জন করা ভারতীয় নির্মাতাদের ক্ষতি করতে পারে।
ভারতকে চরম মূল্য দিতে হবে : গ্লোবাল টাইমস
চীনকে নিয়ে হিসাবে ভুল করলে ভারতকে চরম মূল্য দিতে হবে বলে মন্তব্য করেছে চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম গ্লোবাল টাইমস। গত বুধবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এমন মন্তব্য করে সংবাদমাধ্যমটি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গালওয়ান উপত্যকায় দিল্লির উসকানিতে সীমান্ত সঙ্ঘর্ষের পর ভারতে জাতীয়তাবাদী মনোভাব চরমভাবে বাড়ছে। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সংবাদমাধ্যমগুলো এখনও এ ঘটনা সম্পর্কে ভুল তথ্য ছড়াচ্ছে। তবে চীনা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চাইনিজ পণ্য বয়কট করা ভারতের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনবে না।
আরেক প্রতিবেদনে ২০২০ সালের ১৫ জুন লাদাখ সীমান্তে চীন-ভারত সঙ্ঘর্ষের প্রতি আলোকপাত করা হয়। এতে বলা হয়, ওই সঙ্ঘাতে হতাহতের ঘটনা ছাড়া ভারতের আর কোনও অর্জন নেই।
লাদাখের সঙ্ঘাত নিয়ে বুধবার বিবৃতি দিয়েছে চীনের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। বিবৃতিতে ওই সংঘর্ষের ঘটনায় ভারতীয় সরকার ও দেশটির সংবাদমাধ্যমগুলোর বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করা হয়। বুধবারের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে এ নিয়ে কথা বলেন চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রকের মুখপাত্র ঝা লিজিয়ান। তিনি বলেন, এ বছরের এপ্রিল থেকে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা একতরফাভাবে গালওয়ান উপত্যকার নিয়ন্ত্রণরেখায় রাস্তা ও সেতু নির্মাণ করেছে। চীন একাধিক দফায় এ ব্যাপারে তার ক্ষোভের কথা জানিয়েছে।
তিনি বলেন, ৬ মে রাতে ভারতীয় সেনারা প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে চীনা ভূখন্ডে প্রবেশ করে। গেøাবাল টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, লাদাখের সংঘর্ষের পর ভারতে জাতীয়তাবাদ এবং চীনবিরোধী মনোভাব তীব্র আকার ধারণ করছে। বহু লোকজন চীনা পণ্য বর্জন শুরু করেছে। কেউ কেউ চীনে তৈরি তাদের টেলিভিশন ও ফোনগুলো ধ্বংস করে দিচ্ছে। তাদের এসব কর্মকান্ড চীনের মানুষকে হাসাচ্ছে। অনলাইনে কেউ কেউ মন্তব্য করছে, ‘যতক্ষণ না তোমরা এগুলোর জন্য অর্থ পরিশোধ করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তোমরা ইচ্ছামতো এগুলো ধ্বংস করতে পার।’
এদিকে চীন বয়কট প্রচারণার জেরে ভারতে লাফিয়ে বাড়তে শুরু করেছে ওষুধ তৈরির কাঁচামালের দাম। উত্তরাখন্ডেরওষুধ উৎপাদক কোম্পানিগুলোর বরাত দিয়ে হিন্দুস্তান টাইমস জানিয়েছে, গত কয়েক দিনে দেশটিতে ওষুধের কাঁচামালের দাম বেড়েছে ৩০ শতাংশ। কারণ যাই হোক উদ্ভ‚ত পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষকে বাড়তি দামে ওষুধ কিনতে হচ্ছে। পণ্য মজুত রেখে কালোবাজারির প্রবণতাও দেখা যাচ্ছে সরবরাহকারীদের মধ্যে। ভারতে ওষুধ তৈরির কাঁচামালের ৮০ ভাগই চীন থেকে আমদানি করা হয়। ইউরোপ ও আমেরিকা থেকে এটি সংগ্রহ করতে গেলে দাম পড়বে দ্বিগুণ।
বিবিসি জানিয়েছে, বয়কটের ডাক সত্তে¡ও ভারতে দেদারসে বিক্রি হচ্ছে চীনা স্মার্টফোন ও ইলেকট্রনিক সামগ্রী। গত এক সপ্তাহের মধ্যে বিভিন্ন ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মে চীনা মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলো যেসব প্রোডাক্ট লঞ্চ করেছে, তা ফুরিয়ে গেছে নিমেষের মধ্যে। প্রচুর বিক্রি হচ্ছে রেডমি, অপ্পো, ভিভো, ওয়ানপ্লাসের মতো চীনা কোম্পানির মোবাইল সেট। গত সপ্তাহেই অ্যামাজনে মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে ফুরিয়ে গেছে ওয়ানপ্লাসের লেটেস্ট মডেল। সূত্র : দ্য টেলিগ্রাফ, রয়টার্স দ্য ইউএস সান ও গ্লোবাল টাইমস।