নানা চ্যালেঞ্জ ও প্রতিকূলতার মধ্যে বিদায় নিয়েছে গত অর্থবছর। আজ বুধবার পহেলা জুলাই থেকে বাস্তবায়ন শুরু হলো ২০২০-২১ অর্থবছরের নতুন বাজেট। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বিশ্ব অর্থনীতি এখন বিপর্যস্ত। পাল্টে গেছে বাংলাদেশের অর্থনীতির সব হিসাব-নিকাশও। ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিনতম সময়ে গত ১১ জুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জাতীয় সংসদে ঘোষণা করেন পাঁচ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বিশাল বাজেট, যা গতকাল মঙ্গলবার সংসদে পাস হয়।
করোনাকালে একদিকে জনস্বাস্থ্য ঝুঁকির মুখে, অন্যদিকে অর্থনীতিতে তৈরি হয়েছে বড় ধরনের অনিশ্চয়তা। করোনা সংক্রমণের বিস্তার ঠেকাতে সরকার নানামুখী প্রচেষ্টা নিলেও নিয়ন্ত্রণে আসেনি এখনও। সহসাই সংক্রমণ কমে যাবে এমন নিশ্চয়তাও কেউ দিতে পারছেন না। ফলে বৈরী পরিবেশের মধ্যে অর্থমন্ত্রীকে পথ চলতে হবে আগামীতে। বর্তমান বাস্তবতায় নতুন বাজেট বাস্তবায়ন করা যে কঠিন হবে তা নিজেই স্বীকার করেছেন অর্থমন্ত্রী। গত সোমবার অর্থবিল পাসের সময় সংসদে তিনি বলেন, ‘আমাদের অনেকদূর যেতে হবে; কিন্তু পথ মসৃণ নয়।’ তবে সবাই সহযোগিতা করলে করোনাকালে অর্থনীতিতে যে বিষফোড়া তৈরি হয়েছে তা সামাল দিতে পারবেন। অর্থমন্ত্রী আরও বলেন, কভিড-১৯ এর কারণে যারা কাজ হারিয়েছেন, কষ্টে আছেন, তাদের জন্য এ বাজেট।
এবারের বাজেট বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে নানা প্রতিবন্ধকতার কথা বলেছেন অর্থনীতিবিদরা। তবে প্রধানত তিনটি চালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে অর্থমন্ত্রীকে। প্রথমত, রাজস্ব আদায় পরিস্থিতি খুবই খারাপ। এ বিষয়ে নজর দেওয়া। দ্বিতীয়ত করোনায় অনেকেই কর্মহীন হয়েছেন, তাদের সহায়তা ও অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করা। তৃতীয়ত, করোনা সংক্রমণের বিস্তার ঠেকানো; যদিও এটি অর্থমন্ত্রীর কাজ নয়, তবে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন এর জন্য বাড়তি যে অর্থের প্রয়োজন হবে তার জোগান নিশ্চিত এবং টাকা ঠিকমতো ব্যয় হচ্ছে কিনা সে বিষয়ে তদারকি করতে হবে অর্থমন্ত্রীকে।
সরকারি গবেষণা সংস্থা বিআইডিএসের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় উঠে এসেছে- করোনার প্রাদুর্ভাবে দেশে নতুন করে এক কোটি ৬৪ লাখ মানুষ দারিদ্র্যের কাতারে যুক্ত হয়েছে। করোনার সময়ে শহরে শ্রমিকের আয় কমেছে ৮০ শতাংশ এবং গ্রামীণ শ্রমিকের আয় কমেছে ১০ শতাংশ।
জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পিআরআইর নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, করোনাকালে নতুন করে যারা কর্মহীন হয়ে পড়েছেন তাদের সহায়তা করতে হবে। অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সরকার যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে, তা দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে এবং ঋণ সহায়তা যাতে উপকারভোগীরা পান, সে বিষয়টি সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে। প্রণোদনা প্যাকেজ কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন হলে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে। ফলে কর্মহীন মানুষ দারিদ্র্য থেকে বের হয়ে আসবে।
সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে শুরু থেকে রাজস্ব আয় সন্তোষজনক ছিল না। করোনার কারণে রাজস্ব পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। এনবিআর কর্মকর্তাসহ সংশ্নিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, রাজস্ব আহরণে এ রকম খারাপ অবস্থা আগে কখনও আসেনি। এমন বাস্তবতায় করোনাকালে আরও একটি বড় বাজেট করেছে সরকার। অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, নতুন অর্থবছরের জন্য রাজস্ব আহরণের যে টার্গেট ধরা হয়েছে তা অর্জিত হবে না। যে কারণে বাজেট বাস্তবায়নে অর্থের জোগান দেওয়া সরকারের জন্য কঠিন হবে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, করোনাকালে নানা খাতে সরকারের ব্যয় বাড়বে। কিন্তু করোনার প্রাদুর্ভাব না কমলে রাজস্ব আয় বাড়বে না। ফলে বাজেট বাস্তবায়নে চাপে পড়বে সরকার। এ জন্য রাজস্ব আহরণে বেশি নজর দিতে হবে। তিনি মনে করেন, অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। বিশেষ করে এসএমই খাতকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এটা করা হলে যারা কাজ হারিয়েছেন তাদের আয়-রোজগারের পথ তৈরি হবে। ভোগ-ব্যয়ের চাহিদা বাড়বে। বেগবান হবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড।
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, সবকিছু নির্ভর করছে করোনা পরিস্থিতির ওপর। করোনার বিস্তার না কমলে ঘুরে দাঁড়াবে না অর্থনীতি। আর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বেগবান না হলে সৃষ্টি হবে না কাজের সুযোগ। এ জন্য করোনা নিয়ন্ত্রণ করাই হবে সরকারের প্রধানতম কাজ।
ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, থোক বরাদ্দসহ বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে যে পরিমাণ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, তা বর্তমান বাস্তবতার আলোকে যথেষ্ট। এখন সরকারের কাজ হচ্ছে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে স্বাস্থ্য খাতের ব্যবস্থাপনা ঢেলে সাজানো ও দুর্নীতি বন্ধ করা। এ কাজটি যৌথভাবে করতে হবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে।
নতুন বাজেট বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় যথেষ্ট দুর্বলতা আছে। এ খাতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। অতিমাত্রায় যাতে ব্যাংক থেকে ঋণ না নেওয়া হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। কারণ, এতে করে বেসরকারি খাতের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। সামাজিক সুরক্ষার আওতায় যেসব সুবিধা দেওয়া হয়েছে তা যাতে টার্গেট গ্রুপ পায়, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।