শনিবার, ২৫ মার্চ ২০২৩, ১২:৪৪ পূর্বাহ্ন

নারীর প্রতি সহিংসতার শেষ কোথায়

রিপোর্টারের নাম
  • প্রকাশিতঃ বৃহস্পতিবার, ৯ জুলাই, ২০২০
  • ৪৮ জন নিউজটি পড়েছেন

করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে সারা বিশ্বেই কার্যত লকডাউন চলছে। তেমনি বাংলাদেশে করোনার সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার ফলে বিভিন্ন জায়গায় বর্তমানে অঞ্চলভিত্তিক লকডাউন চলছে। ফলে এই করোনার সময়ে নারী-পুরুষ সবাইকে ঘরবন্দী অবস্থায় থাকতে হচ্ছে। আমরা জানি, যেকোনো ধরনের দুর্যোগ নারী ও পুরুষকে ভিন্ন মাত্রায় প্রভাবিত করে।

বাংলাদেশের মতো সমাজব্যবস্থায় নারীর জীবন এবং স্বাধীনতা শুধু পরিবার নয়; বরং গোটা সমাজই তা নির্ধারণ করে। স্বাভাবিক সময়ে পৃথিবীর প্রায় এক-তৃতীয়াংশ নারী নির্যাতনের শিকার হন। পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, করোনাকালে এই সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে৷ করোনায় নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়ে যাওয়ার কারণে জাতিসংঘ একে কোভিড-১৯–এর ছায়া মহামারি হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) মতে সারা বিশ্বে স্বাস্থ্যসম্পর্কিত কাজে নিয়োজিত লোকবলের মধ্যে ৯০ শতাংশই নারী। কিন্তু দুঃখের বিষয়, নারী যেমন একদিকে ভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দিচ্ছে, অপর দিকে নিজেরাই নির্যাতন নামক ভাইরাসের শিকার হচ্ছে। এই মহাসংকটেও আমরা কি নারীর প্রতি মানবিক হতে পারছি?

করোনার এই ভয়াবহতার মধ্যে গত ১৭ এপ্রিল লক্ষ্মীপুরের রামগতিতে ১৬ বছরের এক কিশোরী ধর্ষণের ঘটনা সাড়া ফেলে দিয়েছিল। জানা গেছে, শুধু মার্চ মাসেই বগুড়া, জামালপুর ও কক্সবাজার জেলায় এমন ৩৬টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে এবং পারিবারিক নির্যাতনের মতো ঘটনা ঘটেছে তিন শতাধিক। বেসরকারি সংস্থা ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’-এর তথ্যমতে, এপ্রিল মাসে লকডাউন চলাকালে দেশের ২৭টি জেলায় ৪ হাজার ২৪৯ নারী পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন। যার মধ্যে ১ হাজার ৬৭২ জন নারীর ক্ষেত্রে এমন ঘটনা প্রথম। ৮৪৮ জন নারী তার স্বামীর দ্বারা নির্যাতিত এবং এর বাইরেও ধর্ষণ, নারী হত্যা, যৌন নির্যাতনের মতো ঘটনা তো রয়েছেই। এপ্রিলের চেয়ে মে মাসে নির্যাতনের ঘটনা বেড়েছে ৩১ শতাংশ। করোনাকালে নারী নির্যাতন শুধু দরিদ্র নয়; বরং উন্নত দেশগুলোকেও প্রভাবিত করছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা বেড়ে গেছে।

রয়টার্সের তথ্যমতে, লকডাউনের প্রথম মাসে ভারত ও তুরস্কে নারী নির্যাতনের ঘটনা দ্বিগুণ বেড়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথম মাসে ৯০ হাজার লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার অভিযোগ এসেছে। অস্ট্রেলীয় সরকারের কাছে অনলাইনে সাহায্য প্রার্থনার হার বেড়েছে ৭৫ শতাংশ। ফ্রান্সে ঘরোয়া নির্যাতন বেড়েছে ৩২ শতাংশ। যুক্তরাজ্যে সরকারি হটলাইনে নারীদের নির্যাতনের অভিযোগ ৬৫ শতাংশ বেড়েছে৷ এদিকে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নারীদের অবস্থা তো আরও শোচনীয়। অথচ আমরা ধারণা করেছিলাম, দৈনন্দিন ব্যস্ততা ছেড়ে লকডাউনের কারণে দাম্পত্য জীবনে পর্যাপ্ত সময় দেওয়ার ফলে পরিবারের পারস্পরিক বোঝাপড়ায় উন্নতি ঘটবে। কিন্তু বাস্তবতা উল্টো।

পুরুষেরা অধিকাংশ সময় ঘরে থাকার ফলে তাদের প্রতিদিনের স্বাভাবিক রুটিনের বিশাল পরিবর্তন এসেছে। অনেকেরই জীবন ও জীবিকা নিয়ে দুশ্চিন্তা বেড়ে গেছে। অনেকে কর্মহীন হয়ে পড়েছে এবং কর্মসংস্থান না থাকায় অর্থসংকটে ভুগছে। ফলে তাদের মধ্যে অবসাদ, মানসিক চাপ, দুশ্চিন্তা বেড়ে যাচ্ছে৷ অনেকে তখন মেজাজ হারিয়ে নারীর প্রতি নির্যাতন করছে। আবার অনেকে এসব কিছুর জন্য নারীকেই দায়ী করছে। গ্রামে এ অবস্থা আরও শোচনীয়। অনেক পরিবার চরম খাদ্যসংকটে ভুগছে। আর্থিক দুরবস্থার ফলে তারা অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। তারা ভাবছে, একটা ‘বোঝা’ অন্তত কমে যাচ্ছে। যার ফলে করোনাকালে বেড়ে গেছে বাল্যবিবাহের ঘটনাও। এভাবে সবকিছুর জন্যই নারীদের নির্যাতিত হওয়ার পেছনে মূলত কাজ করছে যুগ যুগ ধরে চলা প্রচলিত সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি।

এখন সময় এসেছে মনমানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করার। ধর্মীয় অনুশাসন মেনে নারীকে তার সঠিক মর্যাদা দেওয়ার। নারী নির্যাতন বন্ধে অভিভাবকমহলের সংকীর্ণ মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধে পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও ভালোবাসা জাগ্রত রাখতে হবে। প্রচলিত আবদ্ধ সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও চর্চা পরিবর্তনের মাধ্যমে নারীর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত করতে হবে। বৈষম্যের মূল কারণ বের করে সমাধান বের করতে হবে এবং মেয়েদের প্রকৃত স্বাধীনতা দিতে হবে। পুরুষ নারীর প্রতিপক্ষ নয়, নারীও পুরুষের প্রতিপক্ষ নয়। সমাজে নারী–পুরুষের যে ন্যায্য অধিকার ও গুরুত্ব রয়েছে; উভয় মিলে যে অভিন্ন সত্তা, এই মানবিকতাবোধটুকু সমাজ গভীরভাবে উপলব্ধি করতে না পারলে নারীর প্রতি বৈষম্য চলতেই থাকবে। আর এই কাজগুলো শুরু করতে হবে একদম গোড়া থেকে, পরিবার থেকে। তাই আসুন সবাই সহিংসতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই। নিজ নিজ জায়গা থেকে সোচ্চার হয়ে প্রতিরোধ করি নারী নির্যাতন।

নিউজটি আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন

এই ক্যাটাগরির আর নিউজ
© All rights reserved © vira-l.com 2017-2022
themesba-lates1749691102
Bengali English