মঙ্গলবার, ২১ মার্চ ২০২৩, ০৯:৫০ পূর্বাহ্ন

বুড়িগঙ্গায় লঞ্চডুবি: দুর্ঘটনা এড়াতে তদন্ত কমিটির ২০ সুপারিশ

রিপোর্টারের নাম
  • প্রকাশিতঃ বুধবার, ৮ জুলাই, ২০২০
  • ৫১ জন নিউজটি পড়েছেন

রাজধানীর সদরঘাটের কাছে শ্যামবাজার এলাকায় বুড়িগঙ্গা নদীতে যাত্রীবাহী লঞ্চ ‘এমএল মর্নিং বার্ড’ ডুবিতে প্রাণহানির ঘটনায় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে ভবিষ্যৎ দুর্ঘটনা এড়াতে ২০ দফা সুপারিশ করা হয়েছে। এসব সুপারিশে সদরঘাটের আশপাশ থেকে অলস বার্দিং, শিপইয়ার্ড, ডকইয়ার্ড ও খেয়াঘাট স্থানান্তর; নৌদুর্ঘটনার কারণ উদঘাটনে দায়ী মাস্টার-ইঞ্জিন ড্রাইভারদের সঙ্গে সঙ্গে গ্রেপ্তারসহ নৌপুলিশের জনবল বৃদ্ধি; নৌআইন অমান্যকারীদের শাস্তির মেয়াদ ও জরিমানার পরিমাণ যুযোপযোগী করে আইন সংশোধন এবং নৌকর্মীদের প্রশিক্ষণ ফলপ্রসূ করার উদ্যোগ গ্রহণসহ বিভিন্ন পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

তদন্ত কমিটির এসব সুপারিশ পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়নের আশ্বাস দিলেও ওই দুর্ঘটনার আইনি তদন্তের স্বার্থে তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লিখিত দুর্ঘটনার কারণগুলো প্রকাশ করবে না বলে জানিয়েছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। মঙ্গলবার মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে ‘বুড়িগঙ্গায় নৌদুর্ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন’ বিষয়ক ব্রিফিংকালে নৌপরিহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী আরও বলেছেন, লঞ্চডুবির ঘটনায় নিহতদের স্বজনরা যাতে স্বস্তি পায়, আইনি বিচার পায়- সে বিষয়ে সরকার সচেষ্ট ।

এর আগে সোমবার রাতে তদন্ত কমিটির ওই তদন্ত প্রতিবেদন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছিল। মন্ত্রণালয়ের বেঁধে দেওয়া সাতদিনের মধ্যে তদন্ত শেষে এই প্রতিবেদন জমা দেয় কমিটি। এর একদিন পরই মঙ্গলবার এ বিষয়ে প্রেস ব্রিফিংয়ের আয়োজন করে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়।

গত ২৯ জুন সকালে মুন্সিগঞ্জের কাঠপট্টি থেকে ঢাকার সদরঘাটের উদ্দেশে ছেড়ে আসা শতাধিক যাত্রীবোঝাই লঞ্চ ‘এমএল মর্নিং বার্ড’ টার্মিনালে ভেড়ার আগমুহূর্তে শ্যামবাজার এলাকায় চাঁদপুর থেকে ঢাকাগামী আরেকটি যাত্রীবাহী লঞ্চ ‘এমভি ময়ূর-২’ এর ধাক্কায় বুড়িগঙ্গায় ডুবে যায়। এ দুর্ঘটনায় এ পর্যন্ত ৩৪ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। দুর্ঘটনার দিনই নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (উন্নয়ন) রফিকুল ইসলাম খানকে আহবায়ক এবং বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন সংস্থার (বিআইডব্লিউটিএ) পরিচালক (নৌনিরাপত্তা) রফিকুল ইসলামকে সদস্য সচিব করে সাত সদস্যের উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিকে সাতদিনের মধ্যে দুর্ঘটনার কারণ উদঘাটন, দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তি/সংস্থাকে সনাক্তকরণ এবং দুর্ঘটনা প্রতিরোধে করণীয় উল্লেখ করে সুনির্দিষ্ট সুপারিশসম্বলিত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছিল।

দুর্ঘটনার জন্য কারা দায়ী?: সূত্রমতে, তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে দুর্ঘটনার জন্য কাউকে এককভাবে দায়ী করা হয়নি। তবে মর্নিং বার্ড লঞ্চকে ধাক্কা দিয়ে ডুবিয়ে দেওয়ার জন্য অভিযুক্ত লঞ্চ ‘ময়ূর-২’ পরিচালনায় দায়িত্বরত চারজন মাস্টার ও চালকের অসতর্কতা ও অবহেলাকে মূলত দায়ী করা হয়েছে। এই চারজন হচ্ছেন প্রথম মাস্টার আবুল বাশার মোল্লা (২য় শ্রেণির মাস্টার), দ্বিতীয় মাস্টার জাকির হোসেন (৩য় শ্রেণির মাস্টার), প্রথম ইঞ্জিন ড্রাইভার শিপন হাওলাদার (২য় শ্রেণির ড্রাইভার) এবং দ্বিতীয় ইঞ্জিন ড্রাইভার শাকিল সিপাই (৩য় শ্রেণির মাস্টার)। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই চারজন মাস্টার-চালক ময়ূর-২ লঞ্চটিকে অসতর্কতা ও অবহেলার সঙ্গে এবং ভুলভাবে চালাচ্ছিলেন। যার কারণে ধাক্কা লেগে মর্নিং বার্ড লঞ্চটি ডুবে যায়। প্রতিবেদনে ময়ূর-২ লঞ্চের অনিয়ন্ত্রিত গতিকেও দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে উল্লেখ করে আরও বলা হয়, ময়ূর-২ লঞ্চটি রং সাইডে চলছিল। এটি মর্নিং বার্ডের ডানদিকে দিয়ে চলার কথা থাকলেও বাঁ-দিকে চলেছে। তবে দু’টি লঞ্চেরই রেজিস্ট্রেশন, সার্ভে রিপোর্ট ও চলাচলের অনুমোদন সংক্রান্ত কাগজপত্রে কোনো ত্রুটি খুঁজে পায়নি বলে দাবি করেছে তদন্ত কমিটি।

২০ দফা সুপারিশে যা আছে: তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধের পদক্ষেপ হিসেবে প্রথম সুপারিশে বলা হয়েছে, সদরঘাট থেকে ভাটিতে ৭/৮ কি.মি. এবং উজানে ৩/৪ কি.মি. অংশে অলস বার্দিং উঠিয়ে দিতে হবে, এ অংশে পল্টুন ছাড়া নোঙ্গর করা নৌযান রাখা যাবে না এবং পর্যায়ক্রমে শিপইয়ার্ড ও ডকইয়ার্ড উঠিয়ে দিতে হবে। দ্বিতীয় সুপারিশে সদরঘাট টার্মিনালের আশপাশে কোনো খেয়াঘাট না রাখা এবং ওয়াইজঘাটের উজানে খেয়াঘাট স্থানান্তর করার কথা বলা হযেছে।

অন্যান্য সুপারিশে রয়েছে, লঞ্চের সামনে-পেছনে, মাস্টার ব্রিজ, ইঞ্জিন রুম ও ডেকে ব্যাক ক্যামেরাসহ সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো ও লঞ্চে পর্যায়ক্রমে ওয়াকিটকি সিস্টেম চালু; লঞ্চ/জাহাজ ঘাট ত্যাগ করার আগেই লঞ্চের যাত্রী, ডেক সাইড ও ইঞ্জিনে কর্মরতদের সংখ্যা ও বিবরণসম্বলিত ভয়েজ ডিক্লারেশন দাখিল বাধ্যতামূলক করা; ফিটনেসবিহীন লঞ্চ চলাচল বন্ধ ও প্রত্যেক লঞ্চে জীবন রক্ষাকারী লাইফ জ্যাকেট ও বয়া রাখা; সব নদীপথে বিভিন্ন নৌযানের স্পিড লিমিট নির্ধারণ কার পাশাপাশি সদরঘাটে স্পিড কন্ট্রোল করার জন্য টাওয়ার ও সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন; লঞ্চে মেকানিক্যাল স্টেয়ারিংয়ের বদলে ইলেকট্রো হাইড্রলিক স্টেয়ারিং প্রবর্তন এবং যাত্রীবাহী লঞ্চে মেইন ইঞ্জিনস লোকাল কন্ট্রোল সিস্টেমের বদলে ব্রিজ কন্ট্রোল সিস্টেম পর্যায়ক্রমে চালু করা।

সুপারিশমালায় ‘সানকেন ডেক’ লঞ্চ পর্যায়ক্রমে উঠিয়ে দেওয়া ও প্রশস্ত ও ব্যস্ত নদীতে যথাযথ সনদধারী মাস্টার ও ড্রাইভার ছাড়া নৌযান পরিচালনা না করা; যাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য বিশেষ করে শিশু, নারী, বয়স্ক লোকদের উঠানামার সুবিধার্থে গ্যাংওয়ে/ব্রিজ স্থাপন; সদরঘাটে পল্টুনের সংখ্যা বৃদ্ধি; সার্ভের মধ্যবর্তী সময়ে পরিদর্শকদের পরিদর্শন কার্যক্রম আরও জোরদার, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও মোবাইল কোর্টের কার্যক্রম বৃদ্ধি এবং উৎসবসহ সবসময়ের জন্য প্রত্যেক লঞ্চে ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত টিকেট বিক্রি বন্ধ করা ও টিকিট প্রদর্শন ছাড়া কোনো যাত্রীকে লঞ্চে উঠতে না দেওয়ার মত কঠোরতা আরোপের কথা বলা হয়েছে।

এছাড়া সুপারিশে আরও রয়েছে, নৌআইন অমান্যকারীদের শাস্তির মেয়াদ ও জরিমানার পরিমাণ যুগপযোগী করে আইন সংশোধন; নৌকর্মীদের প্রশিক্ষণ ফলপ্রসু করতে বিআইডব্লিউটিএর আরো কার্যকর ভূমিকা ও নৌযানের ফিটনেস কিংবা নৌকর্মীদের যোগ্যতা সনদ ইস্যুতে নৌপরিবহন অধিদপ্তরকে আরো কঠোর ভূমিকা পালন, সার্ভে সনদ প্রদানকারী সংস্থা নৌপরিবহন অধিদপ্তরের সার্ভেয়ারের সংখ্যা ও লজিস্টিক সুবিধা বৃদ্ধি; শিক্ষিত বেকার ছেলে-মেয়েদেরে প্রশিক্ষণ দিয়ে জাহাজে নিয়োগ; নৌদুর্ঘটনার কারণ উদঘাটনে দায়ী মাস্টার ও ইঞ্জিন ড্রাইভারদের সঙ্গে সঙ্গে গ্রেপ্তারের ব্যবস্থাগ্রহণসহ নৌদুর্ঘটনা ও নৌযান সংক্রান্ত অপরাধ নিয়ন্ত্রণ, প্রতিরোধ ও আসামি গ্রেপ্তারে সদরঘাটের নৌপুলিশের জনবল ৯ জন থেকে বাড়িয়ে কমপক্ষে ২৫ জন করা; নৌযান ও নৌকর্মীদের চলাচল জানা ও অবস্থান নিশ্চিত করতে তাদের ডাটাবেজ তৈরি ও ট্র্যাকিং সিস্টেম চালু; নৌট্রাফিক ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন ও দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা/কর্মচারীদের যথাযথ লজিস্টিক সুবিধা প্রদান এবং নৌদুর্ঘটনা গবেষণার বিষয়ে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা।

নৌপ্রতিমন্ত্রী যা বললেন: মন্ত্রণালয়ের প্রেস ব্রিফিংয়ে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বুড়িগঙ্গায় লঞ্চডুবির ঘটনায় আইনশৃংখলা বাহিনী মামলা করেছে। মামলার প্রতিবেদন ১৭ আগস্ট প্রকাশ হবে। আইনশৃংখলা বাহিনীর আইনি তদন্তের স্বার্থে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে উল্লেখিত দুর্ঘটনার কারণগুলো প্রকাশ করা যাচ্ছে না। তবে তদন্ত কমিটির ২০ দফা সুপারিশ পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করা হবে।

নিরাপদ নৌপথ তৈরিতে সরকারের উদ্যোগগুলো তুলে ধরে তিনি বলেন, জনগণের অনুভূতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে অনেক প্রতিকূলতার মাঝেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার কাজ করে যাচ্ছে। গত ১১ বছরে দেশের অন্যান্য সেক্টরের মত নৌসেক্টরও অনেকটা শৃংখলার মধ্যে এসেছে বলেও জানান প্রতিমন্ত্রী।

এ সময় নৌপরিবহন সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ্ উদ্দিন চৌধুরী এবং বিআইডব্লিউটিএ এর চেয়ারম্যান কমডোর গোলাম মোহাম্মদ সাদেক উপস্থিত ছিলেন।

নিউজটি আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন

এই ক্যাটাগরির আর নিউজ
© All rights reserved © vira-l.com 2017-2022
themesba-lates1749691102
Bengali English