নবুয়াতের দশম বছর, শাওয়াল মাস, হাবিবে রব তখন তায়েফের পথে। দ্বীনের দাওয়াতের কাজে রাসূল সা: ১০ দিন সেখানে অবস্থান করেন। রাসূল সা: এই সময় তায়েফের নেতৃস্থানীয়দের কাছে একত্ববাদের দাওয়াত পেশ করেন। তায়েফবাসী তখন রাসূল সা:-এর বাণীর মর্ম বোঝেনি। বোঝেনি রাসূল সা:-এর সম্মান। ঘৃণ্য ব্যবহার, গালমন্দ আর চেঁচামেচি করে তারা আল্লাহর প্রিয় হাবিবের সাথে। কেউবা ইতর ছেলেদের উসকে দেয়, তারা নবী করিম সা:কে বিভিন্নভাবে কষ্ট দেয়, একসময় তারা রাসূলে আকরামের প্রতি পাথর নিক্ষেপ শুরু করে। আল্লাহর প্রিয় হাবিবের জুতা দুটি রক্তে লাল হয়ে যায়, সাথে থাকা যায়েদ বিন হারেসা রা: তাঁকে পাথরবৃষ্টি হতে রক্ষার আপ্রাণ চেষ্টা করেন। পাথর বৃষ্টির ভেতরেই নবী করিম সা: যায়েদ বিন হারেসাকে সাথে নিয়ে উতবা ও শায়বার আঙুর বাগানে আশ্রয় নেন।
এরপর রাসূল সা: মক্কার পথ ধরেন । রাসূলে করিমের হৃদয়ে তখন হতাশার কালো ছায়া । তিনি যখন কারনুল মানাজিল নামক মহল্লায় পৌঁছেন, তখন ফেরেশতা জিবরাইল আ: তাঁর কাছে এসে বলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ সা:! অনুমতি দিন তায়েফবাসীকে আবু কুবাইস ও কুআই কিয়ান পাহাড়ের মধ্যে ফেলে এক চাপ দিয়ে শেষ করে দেই। রাসূল সা: শান্তকণ্ঠে জানালেন, না! তাদের মারবেন না, আমার একান্ত কামনা হয়তো আল্লাহ তায়ালা তাদের বংশধরদের মধ্যে এমন অগণিত মানুষ পাঠাবেন, যারা একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করবে এবং আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করবে না।
অতঃপর আল্লাহ তাই বাস্তব করলেন। ভারতবর্ষে যিনি সর্ব প্রথম ইসলামের দাওয়াত পৌঁছান তিনি ছিলেন এই তায়েফেরই সন্তান মুহাম্মদ বিন কাসিম। তার মাধ্যমে ভারতবর্ষে ইসলাম প্রথম স্থান করে নেয়।
৬২২ সালে, হিজরতের মুহূর্তে কুরাইশ সর্দারদের ঘোষণা করা পুরস্কারের লোভে সুরকা ইবনে জাসাস রাসূল সা:-এর শিরোñেদ করার জন্য তাঁর পিছনে ঘোড়া ছুটায়। সে রাসূল সা:-এর খুব কাছেও পৌঁছে যায়, হজরত আবু বকর রা: এতে ভয় পান। এ দিকে রাসূল সা: দোয়া করছিলেন; সুরকার ঘোড়ার পা বালিতে বসে গেল। সুরকা দুর্বল ও ভীত হয়ে গেল। মক্কা বিজয়ের পর সে ইসলাম গ্রহণ করল, ক্ষমার উজ্জ্বল নক্ষত্র রাসূল সা: সে দিনের অপরাধ সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞেস পর্যন্ত করেননি । সুরকা ক্ষমা পেল এবং আলোকিত দ্বীনের অংশীদার হলো।
হামজা রা: রাসূল সা:-এর চাচা। ইসলামে প্রবেশের পর যিনি অনেক জিহাদে অংশগ্রহণ করেছিলেন। রাসূলে করিম সা: হামজা রা:-এর মৃত্যুতে এত কেঁদেছিলেন যে, অন্য কোনো জানাজায় তাঁকে এমন কাঁদতে দেখা যায়নি। চাচাকে রাসূল সা: কতটা ভালোবাসতেন তা সহজেই অনুমেয় । হামজা রা: শহীদ হয়েছিলেন সত্যের সাথে মিথ্যার যুদ্ধক্ষেত্র ওহুদের ময়দানে। আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দা নিজে হামজা রা:-এর পেট চিরে তাঁর কলিজা বের করে চিবায়। এমন বর্বর হত্যাকাণ্ড চালানোর পরও রাসূল সা: মক্কা বিজয়ের পর আবু সুফিয়ানের স্ত্রীকে ক্ষমা করে দেন। হিন্দার আগের জীবন এবং কর্ম নিয়ে রাসূল সা: কখনোই তাকে কটাক্ষ করেননি।
খায়বারে ইহুদিদের শোচনীয় পরাজয়ের পর জয়নব বিনতে তাহারাত নামের ইহুদি রমণী ভেড়ার গোশত রান্না করে রাসূল সা:কে দাওয়াত করেন । রাসূল সা: এবং বশির বিন রাবারা খাওয়া শুরু করেন। খাবার মুখে দিয়ে রাসূল সা: বিষক্রিয়া বুঝতে পেরে তা ফেলে দেন, বশির রা: মৃত্যুবরণ করেন। নবী সা: জয়নবকে এ কাজের কারণ জিজ্ঞেস করেন । সে বলল, ‘আপনি রাজা বা বাদশা হলে বিষক্রিয়ায় মারা যাবেন আর আমরা মুক্তি পাব, আর যদি নবী হন তাহলে আল্লাহ আপনাকে জানিয়ে দেবেন।’
আল্লাহর রাসূল বললেন, আল্লাহ তোমাকে আমায় হত্যা করার ক্ষমতা দেননি । রাসূল সা:-এর হৃদয় ক্ষমার বিশালতায় আবৃত, তিনি জয়নবকেও ক্ষমা করে দেন। রাসূল সা: নিজেকে হত্যার চেষ্টাকারীকেও ক্ষমা করার মাধ্যমে ধৈর্য এবং সহনশীলতার শিক্ষা দিয়েছেন উম্মতকে।
হাব্বার ইবনে আসওয়াদ রাসূল কন্যা জয়নব রা:কে হিজরতের সময় এমন জোরে ধাক্কা মেরেছিল যে তিনি হাওদা থেকে ছিটকে শক্ত প্রান্তরে গিয়ে পড়ে যান। এতে তার গর্ভপাত হয়ে যায় । মক্কা বিজয়ের পরে হাব্বার ইবনে আসওয়াদ ইসলাম গ্রহণ করেন, রাসূলে করিম সা: তাকেও ক্ষমা করে দেন।
দয়া-মায়া আর ভালোবাসার মূর্তপ্রতীক রাসূল সা:। তিনি মন্দের বদলা কখনো মন্দ দিয়ে নিতেন না, বরং মন্দের বদলে ক্ষমার নীতি অবলম্বন করতেন।
রাসূলে করিম সা:কে জন্মভূমি প্রাণপ্রিয় মক্কা থেকে হিজরত করতে হয়েছিল। অষ্টম হিজরির ১৭ রমজান সকালে রাসূল সা: মাররুয যাহরান থেকে মক্কা অভিমুখে রওয়ানা হন। এ অভিযানে আল্লাহ তায়ালা তাঁকে স্বর্ণদীপ্ত সফলতার পূর্ণতা দান করেন। তিনি কাবাঘরে প্রবেশ করে মানব স্রোতের সামনে ভাষণ দেনÑ আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই, তিনি এক অদ্বিতীয়, তাঁর কোনো শরিক নেই। তিনি তাঁর ওয়াদা সত্যি করে দেখিয়েছেন। তাঁর বান্দাহকে সাহায্য করেছেন এবং সব বিরুদ্ধশক্তিকে পরাজিত করেছেন।
এরপর জিজ্ঞেস করলেন, হে কোরাইশগণ! তোমাদের কী ধারণা, আমি তোমাদের সাথে কেমন আচরণ করব বলে তোমরা মনে করো?
সবাই বলল, আপনি ভালো ব্যবহার করবেন এটাই আমাদের ধারণা, আপনি দয়ালু ভাই, দয়ালু ভাইয়ের পুত্র ।
রাসূল সা: বললেন, তাহলে আমি তোমাদের সে কথাই বলছি যে কথা হজরত ইউসুফ আ: তাঁর ভাইদের বলেছিলেন, লা তাছরিবা আলাইকুমুল ইয়াওম (আজ তোমাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই, তোমরা মুক্ত)।
আদর্শ এ মহামানবের পরিচয় হচ্ছে তিনি মানবতার সর্বোচ্চ চূড়ায় সমাসীন ছিলেন। আল্লাহু সুবহানাহু ওয়াতায়ালা যাঁর প্রশংসায় বলেছেন, ইন্নাকা লা আলা খুলুকিন আজিম।
সহনশীলতার যে অনুপম দৃষ্টান্ত তিনি স্থাপন করে গেছেন তা আবহমানকাল ধরে ইসলামী দুনিয়াকে অনুপ্রেরণা জোগাবে।