মঙ্গলবার, ২১ মার্চ ২০২৩, ১১:১৪ পূর্বাহ্ন

মেধা বনাম চেষ্টা

রিপোর্টারের নাম
  • প্রকাশিতঃ রবিবার, ৫ জুলাই, ২০২০
  • ৪৬ জন নিউজটি পড়েছেন

দীর্ঘদিন কানাডার ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অন্টারিওর উপাচার্য ও প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন বাংলাদেশের রাঙামাটিতে জন্ম নেওয়া অমিত চাকমা। সম্প্রতি ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। শিক্ষা, মূল্যবোধ, ভবিষ্যতের প্রস্তুতিসহ নানা বিষয়ে তাঁর ভাবনা তিনি বাংলাদেশের তরুণদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে চান। তাই শত ব্যস্ততার মধ্যেও নিয়মিত লিখছেন স্বপ্ন নিয়ের জন্য। আজ ছাপা হলো তাঁর চতুর্থ লেখা। আগের তিনটি লেখা পড়তে পারেন অনলাইনে (www.prothomalo.com)
সাফল্যের জন্য মেধা ও চেষ্টা—দুটোরই প্রয়োজন। মেধা বলতে আমরা কী বুঝি? অনেকে মেধা বলতে মস্তিষ্ক বোঝাতে চান। তাঁদের ধারণা, আমাদের মেধা মস্তিষ্কের ওপর নির্ভর করে এবং এটা বংশানুক্রমিক বা জন্মসূত্রে পাওয়া। আমরা জানি, আমাদের সব কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে মস্তিষ্ক। মন-মানসিকতার সঙ্গে মস্তিষ্কের সরাসরি সম্পর্ক আছে। আমরা এটাও জানি যে মস্তিষ্ককে প্রশিক্ষণ দেওয়া যায়। সহজ করে বলার জন্য, এই লেখায় আমি মস্তিষ্ক ও মনকে সমার্থক হিসেবে বিবেচনা করব এবং মেধা বলতে আমি জৈবিক মস্তিষ্কের বদলে মস্তিষ্কের কার্যকলাপকে বোঝাব।

আপনি যদি বেশি সময় ধরে ঘরে বসে থাকেন এবং হাঁটাহাঁটিসহ অন্য শারীরিক কার্যকলাপ কমিয়ে দেন, আপনার শরীরে ধীরে ধীরে জড়তা আসবে এবং আপনার হাঁটতে কষ্ট হবে। তেমনি আমাদের মস্তিষ্ককে যদি অলস করে রাখা হয়, তাহলে মস্তিষ্কেও জড়তা ধরবে। মস্তিষ্ক খুবই স্থিতিশীল এবং প্রশিক্ষণ নেওয়ার অপরিসীম ক্ষমতা এর আছে। আমাদের মস্তিষ্কের এই জৈবিক উপহারকে ভালো কাজে ব্যবহার করতে হবে।

নিজের অভিজ্ঞতা থেকে নিশ্চয়ই জানেন, যত বেশি মুখস্থ করবেন, তত বেশি আপনার মনে থাকবে। আমাদের জন্মের সময় মস্তিষ্ক তাজা এবং প্রায় ফাঁকা থাকে। ধীরে ধীরে আমরা মস্তিষ্ককে নড়াচড়া করা, দেখা ও কথার বলার প্রশিক্ষণ দিই। তারপর যখন পড়াশোনার পালা শুরু হয়, মস্তিষ্কের কার্যকলাপ বৃদ্ধি পেতে থাকে। শিক্ষার এই প্রাথমিক পর্যায়ে, স্মৃতি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং মুখস্থ করে শেখার প্রয়োজনীয়তা তৈরি হয়। মুখস্থবিদ্যার গুরুতর সীমাবদ্ধতা আছে। মুখস্থ করে অর্জিত তথ্য বা জ্ঞানকে সাধারণভাবে ব্যবহার করা কঠিন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এর উপযোগিতা নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটে সীমাবদ্ধ।

বোঝার ক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, আমাদের মস্তিষ্কের ক্ষমতা ও কার্যকারিতা বাড়ানোর জন্য শেখার একটি ভিন্ন পদ্ধতিতে যেতে হবে। তখন মুখস্থ করা চেয়ে জ্ঞান কাঠামো উপলব্ধি করাই হবে মুখ্য। ফলে ধীরে ধীরে জ্ঞানের পরিধি বাড়িয়ে সমালোচনামূলক চিন্তা করার ক্ষমতাও বৃদ্ধি পাবে। সমালোচনামূলক চিন্তা মানে অন্যের সমালোচনা করা নয়, বরং নিজের চিন্তাশক্তিকে যাচাই করা এবং একটা বিষয় বিভিন্ন দিক থেকে ভাবা।

আমার পরিচিত এক বয়স্ক ভদ্রলোক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের আত্মসমর্পণের ঠিক পরপরই মার্কিন বাহিনীর একজন তরুণ গোয়েন্দা কর্মকর্তা হিসেবে টোকিওতে নিযুক্ত হয়েছিলেন। যুদ্ধের আগে তিনি একজন মেধাবী ছাত্র ছিলেন এবং একটি সুপরিচিত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হন। যুদ্ধের কারণে একটি সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ নিয়ে সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করেছিলেন। একদিন টোকিওর একটি শহরতলিতে স্থানীয় দুই দুষ্কৃতকারী দলের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধ শুরু হয়। তাঁর ওপর নির্দেশ ছিল, এই লড়াই সামাল দিতে হবে। তিনি তাঁর সৈনিকদের ঘটনাস্থলে নিয়ে গিয়ে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে এলাকা থেকে বের হওয়ার রাস্তা ঘিরে ফেলেন। কয়েক ঘণ্টা বিক্ষিপ্ত গোলাগুলির পর একটি দল যখন পালিয়ে যাচ্ছিল, তখন তিনি ধাওয়া করে দলের শীর্ষ নেতাকে হাতেনাতে গ্রেপ্তার করে ফেলেন। এ জন্য সাহসিকতার পদকও পান। সেই পদকটি তিনি গর্ব ভরে দেখান। পিস্তলের গুলি দিয়ে এই পদক লাভ করেছেন সে জন্য নয়; কারণ, তাঁর শক্তি ছিল মস্তিষ্কের বুদ্ধি। অস্ত্রবলে পরিস্থিতি দমন করার ক্ষমতা তাঁর হাতে ছিল। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে সেটা বৈধও হতো। কিন্তু তিনি অকারণ প্রাণনাশের ঝুঁকি না নিয়েই একটা গুরুতর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছেন। তিনি তাঁর সমালোচনামূলক চিন্তাকে সুন্দরভাবে ব্যবহার করেছেন।

সাফল্য অর্জনের জন্য মেধার অনুশীলন প্রয়োজন তো বটেই, কিন্তু এটা যথেষ্ট নয়। সাফল্য অর্জন নিশ্চিত করতে হলে অদম্য প্রচেষ্টা অপরিহার্য। ছোটবেলায় কবি কালীপ্রসন্ন ঘোষের কবিতা পড়েছিলাম, ‘পারিব না এ কথাটি বলিও না আর, কেন পারিবে না তাহা ভাব একবার… একবার না পারিলে দেখো শতবার।’ এই সরল কিন্তু ভীষণ উপযোগী কথা অনুসরণ করলেই প্রচেষ্টা অদম্য হবে।

আমেরিকান স্পেশাল ফোর্সের সাবেক কমান্ডার অ্যাডমিরাল ম্যাকরেভেন তাঁর মেক ইওর বেড বইতে একটি সাফল্য অর্জন দিয়ে প্রতিটা দিন শুরু করার উপদেশ দিয়েছেন। তাতে আপনার মনোবল বাড়বে এবং আপনি পরে অন্য কোনো কাজও সফলভাবে করার প্রেরণা খুঁজে পাবেন। উদাহরণস্বরূপ তিনি ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে বিছানা গোছানোর কথা বলেছেন। সারা দিন যদি আপনি একের পর এক ছোট ছোট অনেক কাজ ঠিকভাবে সম্পন্ন করেন, শুধু কাজ সম্পন্ন হবে তা নয়, সুচারুভাবে কাজ করা আপনার অভ্যাসে পরিণত হবে। এই সুন্দর অভ্যাস একটা অসাধারণ গুণে রূপান্তর হবে। ফলে কাজ ছোট-বড় যা-ই হোক, আপনি স্বভাবতই পূর্ণ উদ্যম নিয়ে কাজটা সম্পন্ন করবেন।

আমি নিজে এই পথ ধরেই পৃথিবীর সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করা এবং পরবর্তীকালে উপাচার্যের দায়িত্ব পালনের সুযোগ পেয়েছি। যদিও লেখাপড়ায় মনোযোগী ছিলাম, মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে প্রথম শ্রেণিতে পাস করলেও শীর্ষ দশের তালিকায় উত্তীর্ণ হতে পারিনি। তাই দেশের প্রচলিত মান হিসেবে আমি নিজেকে কখনো মেধাবী ভাবিনি। তবে আমার আত্মবিশ্বাস ছিল, চেষ্টার মাধ্যমে সাফল্য অর্জন করতে পারব। তাই জীবনে যখনই বাধার সম্মুখীন হয়েছি বা পিছিয়ে পড়েছি, কখনো মনোবল হারাইনি। কাজেই আমি নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বলতে পারি, আমাদের সবার মস্তিষ্কের অনেক কিছু শেখার, জানার এবং করার ক্ষমতা আছে। মস্তিষ্ককে প্রশিক্ষণ দিয়েই মেধার বিকাশ করতে হবে। সে জন্য প্রয়োজন চেষ্টা। চেষ্টা না থাকলে মেধা অর্থহীন।

রাঙামাটি উচ্চবিদ্যালয় বা ঢাকা কলেজে যখন ছাত্র ছিলাম, নানা উচ্চাকাঙ্ক্ষা মনে বিচরণ করত, উদ্যম আর চেষ্টার অভাব কখনো ছিল না। তখন কখনোই ভাবিনি আমি দুটি বড় পশ্চিমা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হব। এই সাফল্যের অন্যতম উপকরণ—চেষ্টা। চেষ্টা ছাড়াও আরও কিছু গুণের চর্চা প্রয়োজন। ভবিষ্যতে সেসব নিয়ে লিখব।

নিউজটি আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন

এই ক্যাটাগরির আর নিউজ
© All rights reserved © vira-l.com 2017-2022
themesba-lates1749691102
Bengali English