সরকারি পাটকল খাতে গত ৪৮ বছরের মধ্যে ৪৪ বছরই লোকসান হয়েছে। সর্বশেষ গত অর্থবছর শেষে পুঞ্জীভূত লোকসান দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ২৭০ কোটি টাকা। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী গত অর্থবছরে লোকসান বেড়েছে। চলতি অর্থবছরে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা লোকসানের আশঙ্কা করা হয়েছিল রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের বাজেট প্রকাশনায়।
বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশন (বিজেএমসি) থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, সদ্য সমাপ্ত ২০১৯-২০ অর্থবছরে তাদের আওতায় থাকা ২৫টি পাটকলে লোকসান হয়েছে ৫৯৬ কোটি টাকা। এর আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে লোকসান হয় ৫৭৪ কোটি টাকা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে লোকসানের পরিমাণ ছিল ৪৯৭ কোটি টাকা।
ক্রমাগত লোকসানের কারণে সম্প্রতি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলের উৎপাদন বন্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। বর্তমানে ২৫টি সরকারি পাটকলে ২৬ হাজার শ্রমিক রয়েছেন। গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে তাদের সব পাওনা পরিশোধ করা হবে। খুলনা, চট্টগ্রাম ও ঢাকা অঞ্চলে এসব পাটকল সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের (পিপিপি) ভিত্তিতে পুনরায় উৎপাদনে ফিরিয়ে আনা হবে। নতুন ব্যবস্থপনায় পুরোনো শ্রমিকদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে বলে সরকার আশ্বাস দিয়েছে। পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী বলেন, নতুন ব্যবস্থাপনায় পিপিপির মাধ্যমে পরিচালনা করলে লোকসান থেকে বের হওয়া যাবে। পাটপণ্যের রপ্তানি আয় বাড়বে।
আট মাস আগে বিজেএমসির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পাওয়া আব্দুর রউফের কাছে লোকসানের কারণ জানতে চাইল তিনি বলেন, পুরোনো মেশিনের কারণে উৎপাদন ক্ষমতা অর্ধেকে নেমে এসেছে। শ্রমিকদের মজুরি দিতে হয় সরকারি বেতনের হিসাবে। এ কারণে বেসরকারি খাতের তুলনায় সরকারি পাটকলের শ্রমিকদের মজুরি তিনগুণ। এ ছাড়া সব পক্ষেরই পেশাদারিত্বের সুস্পষ্ট অভাব রয়েছে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পিআরআইর নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা এবং বাজার চাহিদা নিয়ে কোনো গবেষণা না থাকা, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনাসহ নানা কারণে বাণিজ্যিকভাবে লাভবান হওয়ার কোনো সুযোগ নেই সরকারি পাটকলের। সস্তা ও সহজলভ্য দেশি কাঁচামালের সুবিধা সত্ত্ব্বেও দেশে-বিদেশে বাজার হারায় বিজেএমসি। অথচ বাংলাশে থেকে কাঁচাপাট আমদানি করে পণ্য উৎপাদন করে অন্যান্য দেশ বিশ্ববাজার দখল করছে।
জানা যায়, পাটের ছালা, চট, ইয়ার্ন ও টোয়াইন হিসেবে পরিচিত দুই ধরনের সুতা, পাটের কাপড় এবং ২৮০ ধরনের বহুমুখী বিভিন্ন পণ্য রয়েছে পাটপণ্যের তালিকায়। এসব পণ্য অভ্যন্তরীণ বাজারে সরবরাহের পাশাপাশি রপ্তানি হয়। তবে বিজেএমসির মিল শুধু গতানুগিতক চট, ছালা এবং সুতা উৎপাদন, বিক্রি ও রপ্তানি করে থাকে। এসব মিল থেকে আয়ের তুলনায় নানান কারণে উৎপাদন ব্যয় অস্বাভাবিক বেশি। এতে দেশে বেসরকারি খাতের কাছে বাণিজ্য প্রতিযোগিতায় সক্ষমতা হারিয়েছে বিজেএমসি। আর বৈশ্বিক বাজারে কঠিন প্রতিযোগিতায় টিকে রাখা তো দূরের কথা। ফলে আয়ের তুলনায় বেশি ব্যয়ের বোঝা বছর বছর দুঃসহনীয় হয়ে ওঠে। বিজেএমসির পরিচালন ব্যয়ের সঙ্গে অপরিচালন ব্যয়ের বোঝাও শেষ পর্যন্ত পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে দেয়। উৎপাদনের সঙ্গে সম্পর্ক নেই- প্রতি বছর গড়ে ৮০ কোটি টাকার মতো এমন ব্যয় হয় এ খাতে। নতুন অর্থবছরে এই খাতে ব্যয় বেড়ে ৮২ কোটি টাকা হতে পারে বলে চলতি অর্থবছরের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের বাজেট সংক্ষিপ্তসারে উল্লেখ রয়েছে। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বাজেট বক্তৃতায় বলেছেন, রাষ্ট্রায়ত্ত খাতে যুগোপযোগী উৎপাদন ও সেবার মান বাড়ানো হবে। এজন্য সংস্কার কর্মসূচি এবং পিপিপির আওতায় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
গত তিন অর্থবছরের পাটপণ্যের উৎপাদন, উৎপাদন ব্যয়, স্থানীয় বাজারে বিক্রি এবং রপ্তানি পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখা যায়, সবক্ষেত্রেই বিজেএমসির অংশ কমেছে। বেড়েছে শুধু উৎপাদন ব্যয়ের ক্ষেত্র। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বিজেএমসির উৎপাদিত পণ্যের পরিমাণ ছিল দুই লাখ ১৮ হাজার টনেরও বেশি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা মাত্র ৬৯ হাজার টনে নেমে আসে। এ সময় বেসরকারি খাতে উৎপাদিত পণ্যের পরিমাণ ছিল আট লাখ এক হাজার ৫০০ টন। অবশ্য সদ্য সমাপ্ত ২০১৯-২০ অর্থবছরে উৎপাদন কিছুটা বেড়েছে। মার্চ পর্যন্ত নয় মাসে উৎপাদিত পণ্যের পরিমাণ এক লাখ ৪৮ হাজার টন। এ সময় বেসরকারি খাতে উৎপাদিত পণ্যের পরিমাণ সাত লাখ টন। বহুমুখী পাটপণ্যের পরিসংখ্যান হিসাবে নিলে বেসরকারি খাতের পণ্যের পরিমাণ আরও অনেক বেশি। সরকারি পাটকলে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির কারণে বেসরকারি খাতের তুলনায় বিজেএমসির পণ্যের মূল্য প্রায় দ্বিগুণ।
একই চিত্র রপ্তানি বাজারেও। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বিজেএমসি রপ্তানি করেছে ২৬৪ কোটি টাকার পণ্য। এ সময় বেসরকারি খাতের রপ্তানির পরিমাণ পাঁচ হাজার ৭৭২ কোটি টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরের মার্চ পর্যন্ত নয় মাসে বিজেএমসির রপ্তানি ৭৬৫ কোটি টাকা। এ সময় বেসরকারি খাতের রপ্তানির পরিমাণ পাঁচ হাজার কোটি টাকা। বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিজেএমএর মহাসচিব আব্দুল বারেক খান বলেন, স্থানীয়ভাবে বস্তার চাহিদা বেশি। ৮০ কোটি পিস বস্তার চাহিদা আছে দেশে। ১৩৫ কোটি পিস বস্তা তৈরির সক্ষমতা আছে বেসরকারি খাতের। রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধের কারণে পাট খাতের বাণিজ্যে প্রভাব পড়বে না।
বেসরকারি খাতে ৭০০ কোটি টাকার বহুমুখী পাটপণ্য রপ্তানি হয় বছরে। দেশের বাজারে বিক্রির পরিমাণ ৮০ কোটি টাকা। বহুমুখী পাটপণ্যের বড় রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ক্রিয়েশন প্রাইভেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাশেদুল করিম মুন্না জানান, গতানুগতিক পণ্য এবং অব্যবস্থাপনার কারণে বেসরকারি খাতের কাছে মার খাচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত পাট খাত। তিনিও মনে করেন, সরকারি পাটকল বন্ধ হওয়ার কারণে পাট বাণিজ্যে কোনো সমস্যা হবে না। বেসরকারি খাত খুব ভালোভাবেই এই ঘাটতি পূরণ করতে সক্ষম।