বৃহস্পতিবার, ১৯ মে ২০২২, ১০:৩৩ পূর্বাহ্ন
করোনা মহামারিজনিত পরিস্থিতিতে দেশে শিশুর প্রতি সহিংসতা আরও বেড়েছে। চলতি বছর জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সাত মাসে শিশুর প্রতি নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে এক হাজার ১৯৯টি। এ সাত মাসে খুন হয়েছে ৩৬৫ শিশু। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যানে এ তথ্য উঠে এসেছে। পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, করোনার সময় শিশু ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, নির্যাতন, গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনা ও এর ভয়াবহতা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে।
২০২০ সালে একই সময়ে শিশুর প্রতি সহিংসতার ঘটনা ছিল ৯৮৬টি। ২০১৯ সালে বছরজুড়ে ঘটেছিল দুই হাজার ১৮৪টি শিশু নির্যাতনের ঘটনা। আগের বছর যা ছিল এক হাজার ৫৩২টি। গবেষকরা বলছেন, করোনা মহামারি সামাজিক অস্থিরতা ও শিশু নির্যাতনের প্রবণতা বাড়িয়েছে। বিচারহীনতা, বিচারের দীর্ঘসূত্রতা এবং বিকৃত মানসিকতার কারণেও শিশুর প্রতি সহিংসতা বাড়ছে বলে মনে করছেন তারা।
সম্প্রতি জাতিসংঘ শিশু তহবিল বা ইউনিসেফের শিশু নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ (চাইল্ড প্রটেকশন স্পেশালিস্ট) সাবনাজ জেহেরিন বলেন, ‘করোনাকালে শিশুদের ওপর গৃহগত নির্যাতন বেড়ে গেছে।’
কয়েকটি কেস স্টাডি :গত ৭ আগস্ট পুরান ঢাকার চকবাজারের কমলদাহ রোডে শান্ত সজিব জয় নামে ১৪ বছরের এক কিশোরকে গাড়ির নিচে ফেলে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়। হত্যার পর ছিনতাই নাটক ও ডাকাত সাজিয়ে চকবাজার থানায় শিশু বয়সের শান্তসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন বাদী রিয়াজউদ্দিন। এদের প্রত্যেকের বয়স ১৪ থেকে ১৬ বছর। আসামিদের থানায় নিয়ে নির্যাতনও করা হয়। পরে বয়স বাড়িয়ে নির্যাতন চালিয়ে স্বীকারোক্তি নিয়ে সাজানো হয় ছিনতাই ও ডাকাতির মামলা।
রাজধানীর কদমতলীর শহীদ মোক্তার হোসেন রোডের বাসা থেকে অপহরণের শিকার তিন বছরে এক শিশুকে গত ১৩ আগস্ট মানিকগঞ্জের ঘিওর থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। অপহরণে জড়িত পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরদিন শনিবার কদমতলী থানার অফিসার ইনচার্জ জামাল উদ্দিন মীর বলেন, গত ৫ আগস্ট মেহেদী হাসান থানায় অভিযোগ করেন, অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিরা তার তিন বছরের ছেলেকে বাসা থেকে অপহরণ করে। এ-সংক্রান্ত একটি অপহরণ মামলাও করেন তিনি।
গত ৯ আগস্ট ৫ বছরের শিশু জিসানুল ইসলাম আকাইদকে হাত-পা বেঁধে ক্ষুর দিয়ে গলা কেটে হত্যা করা হয়। মোটা অঙ্কের টাকা আদায়ের জন্য তাকে অপহরণ করে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। রাজধানী খিলগাঁওয়ের মধ্য নন্দীপাড়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে রিকশাচালক সেলিমকে গ্রেপ্তার করে সবুজবাগ থানার পুলিশ।
গত ২২ জুলাই রাতে সিলেটে সমাজসেবা অধিদপ্তর পরিচালিত ছোটমণি নিবাসে দুই মাস বয়সী শিশু নাবিল কান্না করলে আয়া সুলতানা বিরক্ত হয়ে তাকে বিছানা থেকে ছুড়ে ফেলেন। বিছানার স্টিলের রেলিংয়ে বাড়ি খেয়ে নাবিল মাটিতে পড়ে জ্ঞান হারায়। তার মুখের ওপর বালিশচাপা দিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। এ ঘটনায় ২৪ জুলাই রাতে সিলেট কোতোয়ালি থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা করে সমাজসেবা কার্যালয়।
কুষ্টিয়ায় গত ১৩ জুন আসমা খাতুন ও শাকিল হোসেনকে গুলি করে হত্যা করে পুলিশের উপ-পরিদর্শক সৌমেন রায়। এ সময় হত্যা করা হয় আসমার চার বছরের শিশু সন্তান তুহিনকে। করোনায় গত দেড় বছরে দেশের বিভিন্ন এলাকায় অসংখ্য শিশুর প্রতি এমন নৃশংসতার একাধিক ঘটনা ঘটেছে।
৭০ শতাংশ যৌন নির্যাতনের শিকার :বেসরকারি এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের পাঁচ থেকে ১২ বছরের শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের ৭০ শতাংশই যৌন নির্যাতনের শিকার।
আসকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত সাত মাসে হত্যার শিকার হয়েছে ৩৬৫ শিশু। যাদের মধ্যে অনেকে গৃহকর্মী। এ ছাড়া ৪৬২ শিশু ধর্ষণের ও অর্ধশতাধিক শিশু বলাৎকারের শিকার হয়েছে। এ সময় প্রায় আটশ শিশু শারীরিক ও যৌন নির্যাতনসহ নানা সহিংসতার শিকার হয়েছে।
মানবাধিকার লঙ্ঘনের এসব ঘটনা স্বস্তিকর নয় বলে মনে করছেন মানবাধিকার কর্মীরা। তাদের মতে, চলমান পরিস্থিতিতে বড় একটা অংশের কর্মহীনতা, আয় কমে যাওয়া বা আয় না থাকা ও অনিশ্চিত জীবনযাত্রার হতাশা থেকে মানুষ সহিংস হয়ে উঠছে। একই সঙ্গে দীর্ঘ সময় ঘরে আবদ্ধ থাকায় নারী ও শিশুরা প্রতিনিয়ত শারীরিক ও মানসিক নিষ্ঠুরতার শিকার হচ্ছে।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, শিশুর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে পরিবারের পাশাপাশি সমাজকেও বড় ভূমিকা পালন করতে হবে। নির্যাতনের ঘটনাগুলো তদন্ত করে দোষীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে প্রশাসনকে।
বিশেষজ্ঞদের অভিমত :এ প্রসঙ্গে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নাছিমা বেগম বলেন, মহামারি করোনার কারণে শিশুরা স্কুলে যেতে পারছে না। তারা বাইরে খেলাধুলা বা আনন্দ-বিনোদন করতে পারছে না। তারা দিনের পর দিন একটা জায়গায় আবদ্ধ হয়ে আছে। শিশুরা স্কুলে যেতে পারলেই নির্যাতন কমে আসবে বলে মনে করেন তিনি। তার মতে, পরিবারের মধ্যেই শিশু নির্যাতন নতুন কোনো ঘটনা নয়। সচেতনতা বাড়ানোর জন্য কমিশন সব সময় কাজ করছে।
বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী আইনজীবী এলিনা খান বলেন, করোনার কারণে গত দেড় বছরের বেশি সময় ধরে স্কুল বন্ধ রয়েছে। ছেলেমেয়েরা স্কুলে যেতে পারছে না। ঘরে থাকতে থাকতে তারা বিরক্ত হয়ে পড়ছে; অভিভাবকদের ওপরও এর প্রভাব পড়ছে। এতে শিশুদের ওপর নির্যাতনের ঘটনা দিন দিন বাড়ছে।
শিশু অধিকার সংগঠন চিলড্রেন চ্যারিটি ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের (সিসিবি) চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার এম আবদুল হালিম বলেন, করোনার কারণে প্রায় দু’বছর ধরে আমরা একটা জায়গায় আবদ্ধ। সামাজিক কোনো কার্যক্রম হচ্ছে না। শিশুরা স্কুলে যেতে পারছে না। পরিবারের মধ্যে সামাজিক অস্থিরতা বিরাজ করছে। ফলে শিশুদের ওপর নির্যাতন বাড়ছে। তিনি বলেন, সমাজে অপরাধপ্রবণতা নিয়ন্ত্রণে সরকারকে নজরদারি আরও বাড়াতে হবে।
কোনো শিশুকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করার ঘটনা বাংলাদেশের সংবিধানে বর্ণিত ২৭, ৩১, ৩২ ও ৩৫ (৫) অনুচ্ছেদে বর্ণিত সাংবিধানিক অধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। সংবিধানে ৩৫(৫) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কোনো ব্যক্তিকে নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দ দেওয়া যাবে না। শিশু আইন ২০১৩-এর ৭০ ধারা অনুযায়ী শিশুদের প্রতি শারীরিক ও মানসিক নিষ্ঠুর আচরণ শাস্তিযোগ্য অপরাধ।