বৃহস্পতিবার, ১৯ মে ২০২২, ১১:৫৩ পূর্বাহ্ন
আবারও আলোচনায় পদ্মা সেতুতে ফেরির ধাক্কা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়ানো ভিডিওতে দেখে গেছে, মঙ্গলবার সেতুর নিচে চলার সময় ‘বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর’ নামের রো রো ফেরির মাস্তুল ধাক্কা খেয়েছে স্প্যানে (ট্রাস)। তাতে প্রশ্ন উঠেছে, মাস্তুলসহ ৫৭ ফুট উঁচ্চতার ফেরি কীভাবে পানি থেকে ৬০ ফুট উঁচু স্প্যানে ধাক্কা খায়? যদিও অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন করপোরেশন (বিআইডব্লিওটিসি) বলছে- ধাক্কা লাগেনি।
ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, স্প্যানের কোথাও আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। কোনো ক্ষতও নেই। তবে ফেরির ধাক্কা ‘ষড়যন্ত্র’ কি-না, তা খতিয়ে দেখার নির্দেশ দিয়েছেন মন্ত্রী।
মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৭টার দিকে সেতুর ২ ও ৩ নম্বর পিলারের মাঝখানে ‘ওয়ান বি’ স্প্যানের নিচ দিয়ে শিমুলিয়া ঘাট থেকে অপর নৌরুট পাটুরিয়া ‘বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর’। ভিডিওতে দেখা গেছে, সেতুর নীচে প্রবেশের সময় স্প্যানে ধাক্কা খেয়ে ফেরির মাস্তুল ভেঙেছে।
পদ্মায় চলাচল করা ফেরিগুলো সরকারি সংস্থা বিআইডব্লিওটিসির। এর চেয়ারম্যান সৈয়দ মো. তাজুল ইসলাম বলেন, ‘স্প্যানে ধাক্কার খবর পেয়ে পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালক, নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা উর্দ্ধতন সেনা কর্মকর্তাদের নিয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। কিন্তু সেতুর স্প্যানে ধাক্কার কোনো আলামত পাওয়া যায়নি।’
সেতুর পিলারে গত দুই মাসে পরপর পাঁচটি ধাক্কার ঘটনায় শিমুলিয়া ঘাট থেকে ফেরি চলাচল বন্ধ রয়েছে। তাই রো রো ফেরিটি পাটুরিয়ায় নেওয়া হচ্ছিল। এ তথ্য জানিয়ে তাজুল ইসলাম বলেন, ‘মাস্তুলেও ধাক্কার চিহ্ন নেই। একটি বাতি ভাঙা পাওয়া গেছে। তবে তা আগে থেকেই ভাঙা। লোহার মাস্তুলের গোড়ায় স্প্রিং রয়েছে। যে কোনো ভারী বস্তুর সংস্পর্শে এলে মাস্তুল স্প্রিংয়ের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নুঁইয়ে যায়। পানি থেকে সেতুর উচ্চতা ৬০ ফুটের বেশি। ৫৭ ফুটের ফেরি পার হওয়ার পরও তিন ফুট জায়গা থাকবে। নদীতে এমন ঢেউও ছিল না, যার তোড়ে ফেরি টালমাতাল হয়ে স্প্যানে লাগবে। আসলে ধাক্কা লাগেনি। ভিডিওটি একটি ভুল বোঝাবুঝি মাত্র।’
গত ১৩ আগস্ট ১০ নম্বর পিলারে ধাক্কা দেয় ‘কাকলি’ নামের ফেরি। ৯ আগস্ট ‘বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর’ ধাক্কা খায় ১১ নম্বর পিলারে। ২৩ জুলাই ‘শাহ জালাল’ নামের আরেকটি ফেরি ধাক্কা খায় ১৭ নম্বর পিলারে। এ ছাড়াও ২ থেকেই ২০ জুলাইয়ের মধ্যে আরও তিনটি ধাক্কার ঘটনা ঘটে।
কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, নির্মাণাধীন পদ্মা সেতুর পিলারগুলো চার হাজার টন জাহাজের ধাক্কায় টিকে থাকতে সক্ষম। ১০ হাজার টনের ‘ফ্রিকশন পেন্ডুলাম বিয়ারিং’ থাকায় রিখটার স্কেলে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প বা সমমানের কম্পন সহ্যক্ষমতা রয়েছে পদ্মা সেতুর। ফেরির ধাক্কায় ক্ষতির শঙ্কা কম হলেও প্রশ্ন এসেছে পদ্মাসেতুর মতো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় কেনো বারবার ধাক্কা খাচ্ছে ফেরি? এর পেছনে ষড়যন্ত্র রয়েছে কি-না সেই প্রশ্ন তুলেছেন মন্ত্রীরাও।
১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের ৪১টি স্প্যানে তৈরি ছয় দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু। নদীতে পানির স্তর যখন সর্বোচ্চ উচ্চতায় থাকবে, তখনও সেতুর সাত থেকে ৩৭ নম্বর স্প্যানের নিচে ১৮ দশমিক ৩ মিটার তথা ৬০ ফুট উচ্চতার জলযান পার হতে পারবে। শত বছরের বন্যার তথ্য বিশ্নেষণ করে এই উচ্চতা নির্ধারণ করা হয়েছে।
পদ্মা সেতুর নির্বাহী প্রকৌশলী দেওয়ান মো. আবদুল কাদের বলেন, এই মুহূর্তে নদীর পানি থেকে ৭ থেকে ৩৭ নম্বর স্প্যান ৬৫ থেকে ৭০ ফুট উঁচুতে রয়েছে। এক থেকে ছয় নম্বর স্প্যান পানি থেকে ৫৭ থেকে ৬০ ফুট উঁচুতে। এই স্প্যানগুলোর নীচ দিয়ে ফেরি চলাচল করার কথা নয়। তবে মঙ্গলবার ওই পথেই চলছিল ‘বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর’। ফেরির মাস্তুল সেতুর স্প্যানে লেগে থাকতে পারে। তবে ধাক্কা বা সংঘর্ষের কোনো আলামত পাওয়া যায়নি স্প্যানে।
এ বিষয়ে পদ্ম সেতু প্রকল্পের পরিচালক মো. শফিকুল ইসলামের বক্তব্য জানা যায়নি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্যানুযায়ী, মঙ্গলবার মাওয়ায় পানির উচ্চতা ছিল ছয় দশমিক শূন্য দুই মিটার। পদ্মায় পানির উচ্চতা সাত দশমিক ১৪ মিটার পানি হলেও সেতুর নীচে ১৮ দশমিক ৩ মিটার জায়গা (নেভিগেশনাল ক্লিয়ারেন্স) থাকবে জাহাজ চলাচলে। এবারের বর্ষায় এখনও এই উচ্চতার চেয়ে সাড়ে তিন ফুট পানি কম রয়েছে। এ হিসেবে মঙ্গলবার পানি থেকে পদ্মা সেতু কমপক্ষে ৬৩ ফুট উঁচুতে ছিল।
স্প্যানে ধাক্কার খবরের পর নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘পদ্মা সেতুর নিরাপত্তায় ১৩ দিন ধরে সেখানে ফেরি চলাচল বন্ধ রয়েছে। আমরা চাই এর সঠিক তদন্ত হোক।’
সেতু পরিদর্শন করে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আগে পদ্মা সেতুর পিলারের সঙ্গে ফেরির ধাক্কা লাগার ঘটনা ঘটেছে। সকালে স্প্যানের সঙ্গে ধাক্কা লাগল। এটাকে নিছক দুর্ঘটনা বা চালকের অদক্ষতা, নাকি ষড়যন্ত্র এবং কেন পদ্মা সেতুতে বারবার আঘাত লাগছে, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’
এ সময় উপস্থিত ছিলেন মুন্সীগঞ্জের জেলা প্রশাসক কাজী নাহিদ রসুল, পুলিশ সুপার আব্দুল মোমেনসহ বিআইডব্লিউটিসি, বিআইডব্লিউটিএ, সেতু বিভাগ ও পদ্মা সেতুর নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ৯৯ কম্পোজিট বিগ্রেডের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
ফেরির ইনচার্জ মো. রাসেল বলেন, দূর থেকে ভিডিও ধারনের কারণে মনে হয়েছে- স্প্যানে ধাক্কা লেগেছে। তার দাবি, সেতুর কাছাকাছি যাওয়ার আগেই মাস্তুল নামিয়ে ফেলা হয়েছিল।
যদিও খবর ছড়ানোর পর বিআইডব্লিওটিসি বলে, চালক ভুলবশত মাস্তুল নামাননি। তাই ধাক্কা লেগেছে। তবে পরে সংস্থাটি ধাক্কার খবর নাকচ করে।